প্রধান মেনু

ঝিনাইদহ থেকে পাটের সুতায় বিশ্বমানের জুতা যাচ্ছে দেশ-বিদেশে

শামীমুল ইসলাম শামীম,ঝিনাইদহ প্রতিনিধি,১৮সেপ্টেম্বর ২০২০ঃ  এক সময় বিশ্ব বাজারে দেশের সোনালী আঁশ খ্যাত পাটের চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী। কৃষিতে উৎপাদিত পাট ও পাটজাত পণ্য সে সময়ে রপ্তানি করে আসতো প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু নানাবিধ কারনে বহিঃবিশ্বে পাটের ঐতিহ্য খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত। দাম কম পাওয়ায় কৃষকেরা কমিয়ে দিয়েছে পাটচাষও। ফলে পাটকলগুলোর সার্বিক অবস্থাও নেই আগের মত। ঠিক এমন অবস্থার মধ্যে পাটের ঐতিহ্য বিশ্ব দরবারে ধরে রাখতে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের রঘুনাথপুর গ্রামে স্থাপিত এ্যামাস ফুটওয়ার লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি পাট দিয়েই তৈরি করছে পরিবেশবান্ধব বিশ্ব মানের নানা ডিজাইনের জুতা। এখান থেকে প্রতিমাসে কমপক্ষে ৩০ হাজার পিয়ার জুতা রপ্তানি করা হচ্ছে স্পেন, ইতালি জার্মানি, ফ্রান্সসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে।পাটের সুতায় হাত ও মেশিনে নকশা করা নানা ডিজাইনের জুতা বিশ্বের সৌখিন মানুষের কাছে চাহিদা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত দেশের জুতার ফ্যাশন শোতেও এই জুতা একাধিকবার প্রদর্শিত হয়েছে বলে দাবি প্রস্তুতকারী কোম্পানীর।

এমন মফস্মল এলাকায় প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীর রপ্তানীযোগ্য জুতা তৈরিতে এ এলাকার প্রায় ৫ শতাধিক হতদরিদ্র অসহায় নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। কোম্পানির কর্তা ব্যক্তিদের ভাষ্য, সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে এ পরিবেশবান্ধব জুতার রপ্তানি বাড়ানোর মাধ্যমে পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সরেজমিনে উপজেলার রাখালগাছি ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামের মাঠের মধ্যে অবস্থিত এ্যামাস ফুটওয়ার কোম্পানির কারখানায় গেলে দেখা যায়, পাট থেকে তৈরি এক ধরনের সুতা সৌখিন এ জুতা তৈরিতে প্রধান কাঁচামাল হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে।  এছাড়াও রাবার গলিয়ে এখানেই মেশিনের ডাইসে ফেলে তৈরি করা হচ্ছে জুতার নিচের অংশ বা সোল। একইভাবে নকশা ও সেলাইযোগ্য পাটের সুতা প্রস্তত ছাড়াও বিশেষ কাপড় এখানেই প্রস্তত করা হচ্ছে। এরপর রাবারের সোলের ওপর কাটা কাপড়ের অংশ বসিয়ে পাটের সুতায় হাতে নকশার সেলাই দেয়া হচ্ছে। এ কাজগুলো কারখানায় বসে করছেন এলাকার মহিলারা। আবার জুতা তৈরির মালামাল মেশিনের প্রাথমিক কাজ শেষ করে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে আশপাশের গ্রামগুলোর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মহিলাদের বাড়িতে বাড়িতে। তারা গৃহস্থালীর কাজের পাশাপাশি কাজ করে পয়সা
রোজগার করছেন।

এ্যামাস ফুটওয়ার লিমিডেট এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক উবাইদুল হক রাসেল জানান, ২০১৩ সালে ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিং বিষয়ে বিবিএ শেষ করে ঢাকায় প্রথম গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করেন। এরপর এলাকার মানুষ ও দেশের জন্য কিছু করার চিন্তা মাথায় আনেন। ভাবনানুসারে ২০১৬ সালের দিকে সরকারি সকল নিয়ম মেনে কালীগঞ্জ উপজেলার যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়কের রঘুনাথপুর মাঠের মধ্যে মাত্র ৪৪ শতক জমির ওপর পাটের জুতা তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। গ্রামাঞ্চল হওয়ায় প্রথম দিকে নানা প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের। ২০১৭ সাল থেকে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি,স্পেনসহ বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোর বায়াররা বেশ চাহিদার সাথে এ জুতাগুলো কিনে নিচ্ছেন। এর আগে কোম্পানীর পক্ষ থেকে পাটের তৈরি জুতার বিশ্ব বাজার সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন দেশের মেলায় জুতার স্টল দিয়ে বায়ারদের নজর কাড়া হয়েছে। ২০১৮ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত ফ্যাশান শো ও মেলায় তাদের তৈরিকৃত সু প্রথম প্রদর্শিত হয় এবং সমাদৃত হয়। ওই বছরেই আমেরিকার লার্স ভেগাস ও ২০১৯ সালে হংকং এ অনুষ্ঠিত মেলায় কোম্পানির পক্ষ থেকে পাটের তৈরি জুতার স্টল দিয়ে বায়ারদের দৃষ্টি কাড়ার পর পাটের জুতার বিশ্ববাজারে চাহিদা আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। তিনি আরও জানান, বর্তমান কোম্পানিতে ৮০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে।

এছাড়াও এলাকার বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ৪ শতাধিক নারীকে প্রথমে জুতা তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কারখানায় প্রতিদিনের হাজিরা বাদে অন্যরা যারা আছেন তারা বাড়িতে বসেই গৃহস্থালীর কাজের পাশাপাশি নির্দেশনা মোতাবেক এই জুতার হাতের কাজ করে থাকেন। কাজ শেষ হলেই কোম্পানীর পক্ষ থেকে আবার জুতাগুলো নিয়ে আসা হয। তিনি বলেন, বাড়িতে বসে একজন মহিলা গৃহস্থালীর কাজের পাশাপাশি কমপক্ষে ৩০ পিয়ার জুতার কাজ করতে পারেন। প্রতি পিয়ারের জন্য দেয়া হয় ৮ টাকা। ফলে তারা বাড়ি বসেই প্রতিদিন ২৮০ থেকে ৩’শ টাকা আয় করতে পারেন। এছাড়াও মহিলাদের মধ্যে যারা কারখানায় কাজ করেন দক্ষতার বিবেচোনায় তাদের বেতন অনেকটা বেশি। আবার যারা কর্মকর্তা আছেন তাদের বেতন ৪০ হাজার পর্যন্ত আছে। উবাইদুল হক রাসেল আরও জানান, তার ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত জুতা তিনি ২ থেকে ১৫ ডলার পর্যন্ত দামে বিশ্ব বাজারে বিক্রি করে থাকেন। চাহিদার কারণে ২ ডলারের জুতা বিদেশে ১৫ থেকে ২০ ডলারে পর্যন্ত বিক্রি হয়। তিনি বলেন, নিজেই বিশ্ববাজারে এই জুতার মার্কেটিং করে থাকেন। সরাসরি বায়ারদের সাথে কথা বলে তাদের মালামাল রফতানি করে থাকেন।

এ্যামাস ফুটওয়ার লিমিটেডের ম্যানেজার মাসুদ রানা জানান, এই কারখানায় তৈরিকৃত জুতা শেষ নামাতে মোট ৬টি স্তর পার হতে হয়। সোল তৈরি হয় রাবার দিয়ে আর জুতা তৈরি হয় পাট দিয়ে। এখানে মেশিন কাজে লাগানো হলেও জুতা তৈরির অর্ধেকের বেশি কাজ করা হয় হাতে। পাটের চিকন মসৃন সুতা দিয়ে সেলাই ও নকশা করলে আকর্ষণীয় হয়। তিনি বলেন, প্রতিমাসে তাদের কারখানা থেকে ৩০ থেকে ৪০ হাজার পিয়ার জুতা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে রফতানি করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান,এই জুতা তৈরির উপকরণ প্রাকৃতিক রাবার, পাট, বিশেষ ধরনের কাপড় সবই পঁচে মাটিতে মিশে যায়। যে কারণে এ জুতা পরিবেশ সম্মত। এ্যামাস ফুটওয়ার লিমিটেডের এই কর্মকর্তা আরো জানান, দেশের আরও কয়েকটি স্থানে পাটের জুতা তৈরি করা হচ্ছে। তবে খুলনা বিভাগে এটাই প্রথম। দেশে পাটের উৎপাদিত জুতা তৈরির আরও কয়েকটি কারখানা থাকলেও খুলনা বিভাগে এটিই প্রথম।