গৃহবধু হত্যার বিচার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন

শাহজাহান আলী মনন, নীলফামারী জেলা প্রতিনিধি ॥ যৌতুকের দাবিতে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার গৃহবধু ও এক সন্তানের জননী লাবলী বেগমের (৩২) অর্থলোভী, নির্যাতনকারী ও ঘাতক স্বামী একরামুল হক চৌধুরীর বিচার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন বাবার পরিবার। ৬ মে বুধবার বিকাল ৪ টায় নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের আইসঢাল হাজীপাড়ায় নিজ বাড়িতে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন লাবলীর বাবা অবসরপ্রাপ্ত রেলওয়ে কর্মচারী মোঃ আব্দুল হাফিজ (৭০)। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন লাবলীর মা রশিদা আক্তার, বড় বোন কেয়া আক্তার, দুলাভাই মোঃ আমজাদ হোসেন, ভাই মমিনুল ইসলাম, নওশাদ আলী ও শরিফুল আলম প্রমুখ।
আব্দুল হাফিজ জানান, আমার মেয়েকে যৌতুকের কারণে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে একরামুল। তাকে সহযোগিতা করেছে বিরামপুরে অবস্থানকারী তার বোন রোজিনা ও দুলাভাই মোস্তাফিজুর। আর একরামুলকে প্ররোচিত করেছে তার বোন ও তাদের বিয়ের ঘটক শিউলি বেগম।কিন্তু এ হত্যাকান্ডকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে। একরামুলের কর্মস্থল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় তার পরিবারের লোকজন বিরামপুরের প্রভাবশালীদের দিয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেছে। সে কারণে হত্যার পর থেকে ছেলে লাবীব কে নিয়ে পালিয়ে থাকা একরামুলককে ধরা বা তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ নেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে পুলিশ। কোনভাবেই যেন হত্যার অভিযোগ না দেয়া হয় সেজন্য প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হয়।
শেষ পর্যন্ত অভিযোগ নেয়া হলেও সেখানে সুকৌশলে মৃত্যুর বিষয়টাকে আত্মহত্যা হিসেবেই চালিয়ে দিতে থানার মুন্সির মাধ্যমে অভিযোগপত্র লিখে নিয়ে বাদি স্বাক্ষর নেয়া হয় লাবলীর বাবা আব্দুল হাফিজের।লাবলীর বোন রেখা আক্তার বলেন, এটা স্পষ্ট ও পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। কিন্তু তারা প্রভাবশালী হওয়ায় মূল ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। যার কলকাঠি নাড়ছে একরামুলের একজন চেয়ারম্যান আত্মীয়সহ সে যে কোম্পানীতে চাকুরী করে সেই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ।
আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। লাবলী হত্যাকান্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। তিনি আরও বলেন, বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের দাবিতে লাবলীর উপর নির্যাতন করে আসছে একরামুল সহ তার বোন শিউলি। শিউলির প্ররোচনায়ই একরামুল হত্যা করেছে লাবলীকে। তা না হলে কেন ঘটনার পর থেকে একরামুল যেমন পলাতক, তেমনি তার পরিবারের কেউ কোন যোগাযোগ করেনি বা সমবেদনাও জানায়নি কেন? কেন তারা কেউই লাবলীর জানাজা, দাফন কাফনেও উপস্থিত হয়নি? হত্যা করেছে বলেই ভয়ে তারা দূরে সরে আছে। এসময় লাবলীর মৃতদেহ গোশল করানোর সময় উপস্থিত ২ জন মহিলা জানান, মৃতদেহে স্পষ্ট নির্যাতনের অসংখ্য চিহ্ন রয়েছে।
তার মাথার চুলগুলো যেন ছিড়ে ফেলা হয়েছে। পিঠে লাঠি দিয়ে আঘাতের কালো দাগ ও পায়ে জখম বিদ্যমান। শরিফুল আলম বলেন, হত্যা করা না হলে একরামুল পলাতক কেন? কেন পুলিশ সুরতহাল রিপোর্টের কপি দিতেও অপারগতা প্রকাশ করছে? কেন বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছেযে, মামলা তুলে নেয়া না হলে লাবলীর ছেলে লাবীব কেও হত্যা করা হবে? আমরা জানিনা ছোট লাবীব এখন কোথায় আছে কেমন আছে? বেঁচে আছে কি না? আমরা চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি। মামলা নিতে যেভাবে গড়িমসি করা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই মামলার বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রেও দীর্ঘসূত্রিতাসহ ভিন্নখাতে প্রবাহের আশংঙ্কা করছি।
তাই তারা এ ব্যাপারে সংবাদকর্মীদের সহযোগিতা কামনা করেন যেন তদন্ত পূর্বক প্রকৃৃত সত্য উদঘাটন করে প্রশাসন সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করে।উল্লেখ্য, গত ৩ মে বিরামপুর থানা পুলিশ প্রফেসর পাড়ার মোঃ রুহুল আমিনের ভাড়া দেয়া বাসার তালাবদ্ধ ঘর থেকে লাবলীর লাশ উদ্ধার করে। পরে লাবলীর বাবা বাদি হয়ে থানায় একটি মামলা করেছে। মামলা নং ২।জানা যায়, প্রতিবেশী মজিবর রহমানের স্ত্রী শিউলি বেগমের ঘটকালীতে তার ছোট ভাই সৈয়দপুর উপজেলার খাতামধুপুর ইউনিয়নের ঝাড়–য়াপাড়া গ্রামের আজিজ চৌধুরীর ছেলে একরামুল হক চৌধুরীর সাথে বিয়ে হয় লাবলীর।
বিয়ের কিছু দিন পর থেকেই স্বামী, শ্বাশুড়ি ও ননদরা যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন শুরু করে লাবলীর উপর। এ নিয়ে অনেকবার স্থানীয়ভাবে শালিস মিমাংসা করা হয় এবং প্রত্যেকবারই একরামুল ভুল স্বীকার করে মাফ চেয়ে লাবলীকে নিয়ে যায়। এভাবে কয়েক দফায় লাবলী স্বামীর সাথে যাওয়ার সময় বাবার বাড়ি থেকে মোটা অংকের অর্থ নিয়ে যায় স্বামীর জন্য। কিন্তু তারপরও কটুক্তিমূলক কথা, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন অব্যাহত থাকলেও ছেলে লাবীবের (৮) মুখের দিকে তাকিয়ে সবকিছু সহ্য করে সংসার করছিল লাবলী। বিগত ৩ বছর যাবত একরামুল চাকুরীর সুবাদে দিনাজপুর জেলার বিরামপুর শহরের প্রফেসর পাড়ায় ভাড়া বাসায় অবস্থান করলেও স্ত্রী ও ছেলেকে বাবার বাড়িতেই রেখে যায়।
এ সুযোগে ননদরা প্রায়ই লাবলীকে লাঞ্চনা-গঞ্জনা করাসহ মারপিটও করে। এতে বাধ্য হয়ে লাবলী বাবার বাড়িতে চলে আসে। পরে একরামুল স্ত্রী ও ছেলেকে বিরামপুরের বাসায় নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানেও লাবলীর উপর নির্যাতন চলতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১ এপ্রিল ২০২০ ইং তারিখ লাবলীকে বেধড়ক মারপিট করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় একরামুল। এতে লাবলী শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে অবস্থান করে। কিন্তু সেখানে ননদরা তাকে উত্যক্ত করায় বাধ্য হয়ে সে বাবার বাড়িতে আসে। তখন পরিবারের লোকজন একরামুলের বোন শিউলি কে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের জন্য অনুরোধ জানায়।
এতে শিউলি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে সকলকে অপমানিত করে এবং বলে তার ভাই একরামুল আর কোন দিনই লাবলীর সাথে সংসার করবেনা। একরামুলকে অন্যত্র বিয়ে দিবে বলেও জানায় শিউলি।এদিকে গত ১ মে একরামুলের বড় ভাই এনামুল চৌধুরী আব্দুল হাফিজের বাড়িতে এসে জানায় যে, একরামুলের অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে। তাই এখনই যদি লাবলী বিরামপুরে একরামুলের কাছে না যায় তাহলে তার সংসার ভেঙ্গে যাবে। একরামুল অন্যত্র বিয়ে করবে।
এনামুলের স্ত্রীর সাথে মুঠোফোনে কথা বলার পর লাবলী বিরামপুর যাওয়ার জন্য উদগ্রিব হয়ে উঠে এবং একাই চলে যেতে চায় একরামুলের কাছে। বাধ্য হয়ে পরিবারের লোকজন ভাগিনা মোঃ রাসেলের সাথে লাবলীকে পাঠায় বিরামপুরে। সেখানে যাওয়া মাত্রই একরামুল চড়াও হয় লাবলীর উপর। রাসেল কে বিদায় দিয়ে চালায় অমানবিক নির্যাতন।এমনকি যাওয়ার পর থেকে খেতে দেওয়া হয়নি লাবলীকে। যা মোবাইলে জানায় লাবলীর ছেলে লাবীব। যাওয়ার ২ দিনের মাথায় গত ৩ মে রবিবার বিকাল ৪ টার সময় বিরামপুরে একরামুলের ভাড়া নেয়া বাসার মালিক স্থানীয় আওয়ামীলীগ সভাপতি মোঃ রুহুল আমিনের মুঠোফোন থেকে জানানো হয় যে লাবলী গলায় ওড়না পেচিয়ে সিড়ি ঘরে আত্মহত্যা করেছে।
খবর পেয়ে বাবা, মা, দুলাভাই ছুটে যায় বিরামপুরে। সেখানে গিয়ে জানতে পারে যে বাহিরের দরজায় তালাবদ্ধ অবস্থায় ঘরের ভিতর লাবলীর লাশ ঝুলে ছিল। খবর পেয়ে পুলিশ এসে এলাকাবাসীর সহায়তায় লাশ উদ্ধার করেছে। ঘটনার পর থেকে স্বামী ছেলে সহ পলাতক। তালা ভেঙ্গে লাশ উদ্ধার করা হলেও থানায় আত্মহত্যার ঘটনা উল্লেখ করে অপমৃত্যু মামলা দেয়ার জন্য বলা হয়।