প্রধান মেনু

ঝিনাইদহ জেলার বিষয়খালী, কামান্না, আলফাপুর ও আবাইপুর শহীদদের গণ-কবরগুলো আজও অবহেলিত

 শামীমুল ইসলাম শামীম,ঝিনাইদহ প্রতিনিধি ২৩ মার্চ ২০১৮ ঃ স্বাধীনতা যুদ্ধে জেলায় প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ঝিনাইদহের
সদর উপজেলার বিষয়খালীতে। এছাড়া শৈলকুপা থানা আক্রমন, কামান্না, আলফাপুর ও আবাইপুরের যুদ্ধ আজও স্মৃুতিতে অম্লান। ঝিনাইদহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল সংসদ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল যশোর ক্যান্টোনমেন্ট থেকে ভারী অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে
পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী ঝিনাইদহ দখলের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসতেথাকলে বিষয়খালী ব্রীজের এপার থেকে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীদের প্রবাল বাধা দেয়। প্রায় তিন ঘন্টা যুদ্ধের পর তারা পিছু হঠে যায়। ১৬ এপ্রিলে হানাদার বাহিনী আবারো বিষয়খালী বেগবতী নদীর তীরে এসে
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল বাধার সম্মুখিন হয়। এখানে প্রায় ৬ ঘন্টা তুমুল যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ব্রীজের পাশেই তাদের গণ কবর দেওয়া হয়। এ থেকেই জেলায় ছড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধ। বিভিন্ন পাকিস্তানের তুমুল যুদ্ধ শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। সে সময় উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের মধ্যে ছিল বিষয়খালী যুদ্ধ, গাড়াগঞ্জ যুদ্ধ, শৈলকুৃপা থানা আক্রমন, কামান্না, আলফাপুর ও আবাইপুরের যুদ্ধ।

ঝিনাইদহে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সুত্রে জানা গেছে, পহেলা থেকে ১৬ এপ্রিল বিষয়খালী যুদ্ধে ৩৫ জন, ১৪ অক্টোবর আবাইপুর যুদ্ধে ৪১ জন, ২৬ নভেম্বর কামান্না যুদ্ধে ২৭ জনসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝিনাইদহ জেলায় ২৭৬ জন মুক্তিযুদ্ধা শহীদ হন। এর মধ্যে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে এই জেলায় দুই জন। তাঁরা হলেন বীর শ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ও বীর প্রতিক সিরাজুল ইসলাম। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আনেককে বিভিন্ন স্থানে গণকবর দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে আনেকের নাম ঠিকানা আজও মেলেনি। ৬ ডিসেম্বরের আগে ৩ ডিসেম্বর মহেশপুর, ৪ ডিসেম্বর কোটচাঁদপুর, ৫ ডিসেম্বর কালীগঞ্জ এবং সর্বশেষ ১১ ডিসেম্বর শৈলকুপা উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়। ৫ ডিসেম্বর মধ্যরাতে মিত্র বাহিনী ঝিনাইদহের হলিধানী বাজারে এসে খবরা খবর নিতে আসেন। তারপর তারা ৬ ডিসম্বর ভোরে ঝিনাইদহ শহরে প্রবেশ করেন। মিত্র বাহীনির নেতৃত্বে ছিলেন, কর্ণেল বাহেলে ও লেঃ কর্ণেল পিকে দাস গুপ্ত। ৬ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় ঝিনাইদহের ইউনিট কমান্ডার হিসেবে তিনিসহ ইউনিয়ন কমান্ডার রজব আলী, বাকুয়া গ্রামের মরহুম মনিরুল ইসলাম, নারিকেল বাড়িয়ার বুলু মিয়া, গাবলা গ্রামের মকছেদ আলীসহ অনেকে মিত্র বাহিনীকে স্বাগত জানিয়ে দ্রুত ঝিনাইদহে বেসামরিক প্রশাসন চালু করার প্রস্তাব দেন।

তখনও সারা দেশে শামরিক শাসন চলছে। বাংলাদেশের প্রথম ঝিনাইদহ জেলায় বেসামরিক প্রশাসন চালুর ফলে পাকিস্তানের মুক্ত হয় ঝিনাইদহ। ঝিনাইদহের শৈলকুপার আবাইপুর গণ-হত্যা দিবস প্রতি বছর পালিত হয়। কিন্তু আবাইপুরে ৪১ মুক্তিযোদ্ধার গণকবর আজও অবহেলিত ও উপেক্ষিত । জঙ্গলে ছেয়ে আছে কবরগুলো, ফলে বোঝার উপায় নেই এগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর। নতুন প্রজন্মের মানুষ এখন ভুলতে বসেছে এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথা, রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর গুলো সংরক্ষণের দাবি সর্বস্তরের মানুষের। ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার প্রত্যন্ত কুমিড়াদহ গ্রামে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অবস্থানরত সুবিধার কারনে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গোপন ঘাটি গড়ে উঠেছিল। অক্টোবর মাসে কুমিড়াদহের ঘাটিতে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা জড়ো হন। এয়ারম্যান মজিবর রহমানের নেতৃত্বে নজরুল ইসলাম, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মনোয়ার হোসেন মালিতা এবং গোলাম রইচ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে সহকর্মীদের নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। ১৪ অক্টোবর ভোর রাতে পাকহানাদাররা অপ্রত্যাশিত ও অতর্কিত ভাবে মুক্তিসেনাদের উপর আক্রমন করে। আকস্মিক আক্রমনে মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে হতবিহ্বল ও দিশেহারা হয়ে পড়লেও অসীম সাহস ও মনোবল নিয়ে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে । কিছু অতর্কিত আক্রমনের ফলে মুক্তিযোদ্ধারা বেশিক্ষন হানাদারদের সাথে যুদ্ধ করে পেরে ওঠেন না

। সেই দিনের যুদ্ধে শহীদ হন ৪১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। পাক হানাদাররা স্থান ত্যাগ করার পর এলাকাবাসী তড়িঘড়ি করে তাদেরকে ৫ টি গণকবরে সমাহিত করে। শহীদদের গণকবরগুলোর মধ্যে ১১নং আবাইপুর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের পাশে ১৭ জন শহীদের কবর ১টি প্রাচীর দ্বারা সংরক্ষন করা হয়েছে। এছাড়া আবাইপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড কলোনীর ভিতরে ও জিকে সেচ খালের (ক্যানেল) ব্রীজের পার্শে ২ টি গণকবরে ১৮ জন কে সমাহিত করা হয়। এছাড়া শৈলকুপার ব্রীজের সামনে ৬ জনকে সমাহিত করা হয়। প্রতি বছর শুধুমাত্র মিলাদ মাহফিলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে এসব দিবসের কার্যক্রম। রক্তাক্ত ২৬ নভেম্বর, ঐতিহাসিক কামান্না শহীদ দিবস পালন করা হয়। ১৯৭১ সালের এই দিন ভোররাতে মাগুরা ও ঝিনাইদহ জেলার সীমান্তবর্তী কামান্না গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হামলায় মাগুরার ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ গণহত্যাযজ্ঞে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের বেশীর ভাগের বাড়ি মাগুরা সদর উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নে।

১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর রাতে মাগুরার এক দল মুক্তিযোদ্ধা পার্শ্ববর্তী শৈলকুপা উপজেলার কামান্না গ্রামে গিয়ে রাত্রি যাপনের জন্য মাধবকুন্ডু নামে এক ব্যক্তির বাড়ির পরিত্যক্ত একটি টিনের ঘরে অবস্তান নেন। কিছু এ খবর স্থানীয় রাজাকাররা শৈলকুপা ও মাগুরার পাকি বাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়। খবর পেয়ে রাজাকার আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় শৈলকুপা ও মাগুরা থেকে আসা পাকি সেনারা ওই রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। আচমকা এ আক্রমণের মুখেও প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। কিছু বিশ্বাসঘাতক রাজাকারদের সহযোগিতাপুষ্ট অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকি বাহিনীর ওই হামলায় ২৭ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। কামান্না যুদ্ধে শহীদ ২৭ মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছেন -আলমগীর হোসেন, আলী হোসেন, কাদের, মোমিন, সলেমান, ওয়াহেদ, আজিজ, আকবর, রিয়াদ, শরীফুল, আলিউজ্জামান, মনিরুজ্জামান, মাছিম, রাজ্জাক, শহিদুল, আব্দুর রাজ্জাক, কাওছার, সালেক, সেলিম, মতলেব, হোসেন আলী, খন্দকার রাশেদ, গোলজার, তাজুল ইসলাম, আনিসুর, গৌর ও অধীর।