ঢাকা- ময়মনসিংহ রেলপথে এক সপ্তাহে দুই খুন, ৫ ছিনতাই, গত ১ বছরে ৪২ খুন

শফিউর রহমান সেলিম, গফরগাঁও (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি : ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে ট্রেনে বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা সবকিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। ছিনতাইকারীদের লোলুপ দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে যাত্রীদের প্রাণ। একের পর এক ঘটছে হত্যাকান্ড। অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হচ্ছে ট্রেন যাত্রীদের।
এসব নির্মম হত্যাকান্ডে ট্রেনের যাত্রীরা অসহায় ও আতঙ্কিত। একেকটা ঘটনা ঘটার পর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা আশ্বস্ত করেন যাত্রী নিরাপত্তায় ট্রেনে পুলিশি ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কর্তৃপক্ষের ওই ঘোষণা শুধু বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
ব্যবসায়ী খোকন খান (৩৮)। তিনি নেভী সিগারেট কোম্পানীতে চাকরী করতেন। গত দুই মাস পূর্বে চাকরী ছেড়ে সিগারেট বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। গত ২৩ মার্চ শুক্রবার দিনভর গাজীপুরের টঙ্গী চেরাগআলী মার্কেট এলাকায় সিগারেট সাল্পাই দেন।
পরে বাড়ি আকুলতায় রাতের ট্রেনে চেপেই রওনা হন। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কি বুঝতে পেরেছিলেন, জীবনের শেষ ট্রেনেই চেপে বসেছেন তিনি। ট্রেনটি গফরগাঁওয়ের চারিপাড়া রেলসেতু সংলগ্ন এলাকায় পৌছলে সর্বস্ব লুটে নিয়ে তাকে ট্রেন থেকে ফেলে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা। নিহত খোকন গফরগাঁওয়ের পাঁচবাগ ইউনিয়নের দীঘিরপাড় গ্রামের আঃ ছালামের ছেলে।
গত ১ এপ্রিল শনিবার ঢাকাগামী আন্তঃনগর তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনে ছাদে ছিনতাইকারীরা গণছিনতাই শেষে ১৬ বছর বয়সের এক কিশোরকে হত্যা করে।
ট্রেনটি গফরগাঁও-ময়মনসিংহের মধ্যবর্তী আউলিয়া নগর রেলস্টেশন অতিক্রমকালে ট্রেনের ছাদ থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়তে দেখে যাত্রীরা হৈচৈ শুরু করে। পরে দায়িত্বরত জিআরপি পুলিশ ছাদে উঠে খুন অজ্ঞাত এক কিশোরের রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে গফরগাঁও জিআরপি পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দেয়।
এ সময় জিআরপি পুলিশ ছাদে ভ্রমণরত সন্দেহ জনক ফুলপুর গোদারিয়া গ্রামের লালমিয়ার ছেলে বাবুল (১৮), গৌরীপুর থানার নয়াপাড়া গ্রামের আমিনুল ইসলামের ছেলে ফরিদুল ইসলাম (২৫), শেরপুর সদরের রামকৃষ্ণপুর এলাকার আব্দুল করিমের ছেলে ফারুক মিয়া (২৫) ও নেত্রকোনা জেলার বাহাম গ্রামের আব্দুল আজিজের ছেলে কাইজুল মিয়াকে (২০) আটক করে।
এ রেলপথে এর আগেও অসংখ্য যাত্রীর প্রাণ গেছে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীদের হাতে। সামান্য কিছু টাকা আর মুঠোফোনের জন্য যাত্রীদের হত্যা করছে ছিনতাইকারীরা। এসব হত্যাকান্ড চলছে বছরের পর বছর ধরে। যেন দেখার কেউ নেই। ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথটি ছিনতাইকারীদের নিরাপদ জোনে পরিণত হয়েছে।
গত ২০১৭ সালে মাত্র তিন মাসে এ পথে ৩৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর ধলা ও বালিপাড়া এলাকায় দুজনকে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা। একই বছরের ১০ আগষ্ট গফরগাঁওয়ের রৌহা নামক স্থানে ভাওয়াল এক্সপ্রেস ট্রেনের ছাদে সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়ে অজ্ঞাত ছুবককে ফেলে দেয় দূর্বৃত্তরা। এতে ওই যুবক মারা যান।
একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা জামালপুর, বাহাদুরাবাদ ঘাটগামী সেভেন আপ ট্রেনের ছাদ থেকে ফেলে অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবককে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা। এছাড়াও ট্রেনের ছাদে ছিনতাই শেষে অনেক যাত্রী ফেলে দেয়ার ঘটনায় কেউ নিহত হচ্ছেন কেউবা আবার চিরতরে পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
আর নিহত হওয়া অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের জামাকাপড় রেলওয়ে ডোম ঘরের সামনে ঝুলিয়ে রাখা হয় মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। তবে বছর দুয়েকের মধ্যে স্বজনদের সন্ধান না পাওয়া গেলে ‘অজ্ঞাতনামা’ হিসেবেই থেকে যায়। চলন্ত ট্রেনে আওয়াজ থাকায় কেউ কিছুই টের পাবে না, এ সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে পেশাদার চক্রটি।
এভাবেই প্রাণ হারাচ্ছেন রাতের ট্রেনের ছাদে ভ্রমনকারী যাত্রীরা। তবু কোনো প্রতিকার খুঁজে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। আবার দুয়েকটা ঘটনায় হাতেনাতে ধরাও পড়ে ছিনতাইকারীরা। কিন্তু পর্যাপ্ত সাক্ষী আর আলামতের অভাবে সহজেই জামিন পেয়ে যায় অপরাধীরা।
গত শুক্রবার বিকালে গফরগাঁওয়ে কমিউটার ট্রেনে চলন্ত অবস্থায় গণ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ সময় যাত্রীরা রায়হান নামে এক ছিনতাইকারীকে আটক করে জিআরপি পুলিশে সোর্পদ করে । আটক ছিনতাইকারীকে ছিনিয়ে নিতে সংয়ঘবদ্ধ ছিনতাইকারী দল গফরগাঁও জিআরপি পুলিশ ফাড়িতে হামলা চালায়। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে চলে এ তান্ডব।
কিন্ত জিআপরপি পুলিশ ভেতর থেকে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়ায় আটক ছিনতাইকারীকে ছিনিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। গতকাল শুক্রবার বিকাল সোয়া ৫টার দিকে গফরগাঁও রেলওয়ে ষ্টেশনে এ ঘটনা ঘটে।
গফরগাঁও জিআরপি ফাঁড়ির ইনচার্জ শফিকুল ইসলাম খান দাবী করে বলেন, স্থানীয় কিছু ছেলে-পেলে আটক ছিনতাকারীকে ছাড়িয়ে নিতে ফাঁড়ির দরজার ধাক্কাধাক্কি করেছে। তবে ছিনতাইকারীকে ময়মনসিংহ জিআরপি থানায় পাঠানো হয়েছে।
ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার ইব্রাহীম (৩২) ও গাজিপুর শহরের দক্ষিন চত্বর এলাকার নূরুল হক (৩৫) জানায়, বালিপাড়া ষ্টেশন অতিক্রমকালে ছিনতাইকারীদল ছিনতাই শুরু করে। এ সময় বাধা দেওয়ায় চেষ্টা করলে ছিনতাইকারীরা যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে মারধর করে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিতে চায়। সাথে থাকা টাকা-পয়সা, মোবাইলসহ জিনিসপত্রসহ সর্বস্ব ছিনতাইকারীদের হাতে তুলে দিয়ে যাত্রীরা রক্ষা পায়।
গত সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে চলাচলকারী বলাকা ট্রেনটি ময়মনসিংহ স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ট্রেনটি ফাতেমানগর পার হওয়ার সময় ছাদে ভ্রমণরত যাত্রী গফরগাঁওয়ের রৌহা গ্রামের বাসিন্দা হানু মিয়া ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। এ সময় বাধা দেওয়ায় ছিনতাইকারীরা তাঁকে মারধর করে।
পরে ট্রেনটি গফরগাঁও স্টেশনে দাঁড়ালে ছিনতাইকারীরা দৌড়ে পালানোর সময় আক্রান্ত হানু মিয়া চিৎকারে জিআরপি ফাঁড়ি পুলিশ জনি মিয়া, অনন্ত ও আনারুল নামের তিন ছিনতাইকারীকে আটক করে। এ নিয়ে গত ১৫ দিনে এ রেলপথে অন্তত ৫টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
ময়নমনসিংহ রেলওয়ে থানার ওসি আব্দুল মান্নান বলেন, ট্রেন যাত্রীদের হত্যার ঘটনায় তদন্ত করছে রেলওয়ে পুলিশ। পাশাপাশি নিরাপত্তা জোরদারে কাজ চলছে।