১২ ডিসেম্বর শ্রীপুর পাক-হানাদার মুক্ত হয়
ইব্রাহিম মাহমুদ, শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি।। ১২ ডিসেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুর পাক-হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে শত্রুমুক্ত হয়েছিল গাজীপুরের শ্রীপুর অঞ্চল। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তির্যক আক্রমনে টিকতে না পেরে ১১ ডিসেম্বর বিড়ালের মত লেজ গুটিয়ে রাতের আধারে শ্রীপুর ছাড়তে শুরু করে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। ধর্ষণ, গণহত্যা, বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ, মালামাল লুন্ঠন আর অবসর প্রাপ্ত সেনা সদস্যদের হত্যা, পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধের মধ্য দিয়েই ১২ ডিসেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা পশ্চিম পাকিস্তানী পাক-হানাদারদের হঠিয়ে শত্রুমুক্ত করে বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা। আর সকালেই শ্রীপুরের মাটিতে উড়ে প্রথম লাল সবুজের স্বাধীন পতাকা।
সাধারণ নিরীহ মানুষের ওপর পাকবাহিনীর অত্যাচার, রাজাকারদের মাধ্যমে বাড়ি থেকে ধরে পাকিস্তানী ক্যাম্পে নিয়ে নারী ধর্ষণ, মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে মুক্তিযোদ্ধার বাবা, মা, ভাই,বোন আত্বীয় স্বজনদের হত্যা করে গণকবর দেয়া, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যাসহ নানা রকম ধ্বংস লীলা থেকে রক্ষার মধ্য দিয়ে শ্রীপুর থেকে পাক সেনাদের বিতাড়িত করেন মুক্তিযোদ্ধারা। শ্রীপুর থেকে পাকসেনাদের যোগাযোযোগের জন্য রেলপথ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। চারদিক থেকে আক্রমণের পর ১২ ডিসেম্বর শ্রীপুর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং আত্মগোপনে চলে যেতে থাকে রাজাকার ও তাদের দোসররা।
১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর ভোরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ নিরাপত্তার দায়িত্বে পাকিস্তানী সেনাদের সাথে শ্রীপুরের ইজ্জতপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়।গোসিঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র কিশোর সাহাব উদ্দিন ওই যুদ্ধে শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় ও প্রচন্ড গুলি বর্ষণে সেখানে চারজন রাজাকার ও একজন পাকসেনাও নিহত হয়েছিল।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল পাক-হানাদার বাহিনী শ্রীপুরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয়। শ্রীপুর থানা, গোসিংগা কাচারি বাড়ি, কাওরাইদ রেলস্টেশন, সাতখামাইর রেলওয়ে স্টেশন, গোলাঘাট রেলওয়ে ব্রিজ, ইজ্জতপুর ব্রিজ, বলদি ঘাট হাইস্কুলসহ বেশ কয়েকটি স্থানে গড়ে তুলে ৮টি পাক সেনা ক্যাম্প। রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাস থেকে ট্রেনযোগে শ্রীপুর অঞ্চলে পাক হানাদারদের ছিল সহজ যোগাযোগ। শ্রীপুর থানায় ছিল পাক-হানাদারদের প্রধান ঘাঁটি। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় হানাদার বাহিনী নিরীহ নারী পুরুষ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের ধরে এনে এসব ক্যাম্পে বর্বর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করতো।
বাবার লাশটিও পেলেন না গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কেওয়া আকন্দবাড়ী গ্রামের শহীদ সাদির আকন্দের ছেলে নুরুজ্জামান আকন্দ বলেন, ১৯৬৫ সালে তাঁর বাবা তৎকালীন সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তরুন যুবকদেও প্রশিক্ষিত করে তোলার ভয়ে পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের চিহ্নিত করে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল টঙ্গী অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলের সামনে ফজরের নামাজ শেষে তাঁর বাবা বাসায় ফিরছিলেন। তখন দেশে কারফিউ চলছিল। ওই অবস্থায় তাঁর বাবা পাক সেনাদের সাথে মানুষ হত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন। কথোপকথনে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য হিসেবে তাঁর পরিচয় পাওয়ার পর সাতটি বুলেটের আঘাতে পাকিস্তানী সেনারা নির্মমভাবে তাকে হত্যা করে। সবশেষে তার লাশটিও রেখে যায়নি হানাদার বাহিনী। স্বজনরা বিভিন্নস্থানে খুঁজে আজও তার সন্ধান পাননি।একে একে ১০ জনকে বেঁধে এনে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে।
শ্রীপুরের সাতখামাইর গ্রামের আব্দুস ছাত্তারের স্ত্রী হারেছা খাতুন বলেন, পাকিস্তানী সেনারা তার স্বামীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। তার স্বামীর সঙ্গে একই এলাকার ইউসুফ আলী, আজম আলী, আব্দুল লতিফ, গিয়াস উদ্দিন, ছসু মোল্লাসহ মোট ১০ জনকে হত্যা করে সাতখামাইরে গণকবর দেয়া হয়। তাদের মধ্যে সাত মাসের সস্তান সম্ভবা সালেহা এবং অপর যুবতী শিরীনকে পাকিস্তানী সেনারা শ্রীপুরে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে শ্রীপুরের জিনেজানের রেলসেতুর কাছ থেকে তাদের মাথার চুল, কঙ্কাল এনে গণকবরে সমাহিত করা হয়। শ্রীপুর বধ্যভূমিতে ১২ জনের দেহ।শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী কলেজ মাঠের একপাশে ১২ জন শহীদের গণকবর রয়েছে।
শ্রীপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার সিরাজুল হক বলেন, কেওয়া আকন্দবাড়ীর শহীদ আলমগীর বাদশা আকন্দের ছেলে নজরুল ইসলাম আকন্দ মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ায় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানীরা বাড়ি থেকে তার বাবাকে ধরে এনে হত্যা করে। তার বাবা ফকির আলমগীর বাদশা আকন্দের সাথে আরও কমপক্ষে ১১ জনকে হত্যার পর গণকবর দেয়া হয়।পাকসেনাদের অবস্থান ও মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা,মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকসেনাদের স্থল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল রেলপথ। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ এবং উত্তরের জেলাগুলোর সাথে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথকেই তারা নিরাপদ মনে করত। গোলা বারুদ ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র মালবাহী ট্রেনে আনা নেয়া করত। ঝুঁকিপূর্ণ স্থান বিশেষ করে রেল সেতু এলাকায় পাকিস্তানী ক্যাম্প তৈরী করে পাহারা বসিয়ে রাখত।
তিনি আরো বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা ছিল পাক সেনাদের ওপর আক্রমণ করে রেলসেতু ধ্বংস করতে পারলে তাদের যোগাযোগ বন্ধ হবে। এর আগেই ভারত থেকে প্রশিক্ষণ ফেরত গাজীপুরের দুইশ জন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যুদ্ধ করছে। সেকশন কমান্ডার মিয়ার উদ্দিনের বাড়ি ডোয়াইবাড়ী গ্রামে। তার পরামর্শে ইজ্জতপুর রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশে রেলসেতু ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা হয়। ইজ্জতপুর গ্রামের নূরুল ইসলাম সিরাজী ও তার ভাই জসীম উদ্দিন সিরাজীর
বাড়িতে ৬ ডিসেম্বর কমপক্ষে দেড়শ প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা সমবেত হন।পাকি ক্যাম্পের খোঁজ দিতেন বাবুর্চি তমিজ উদ্দিন পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্পে বাবুর্চি হিসেবে কাজ করতেন স্থানীয় তমিজ উদ্দিন। তার মাধ্যমে সেনা ক্যাম্পের খোঁজ খবর নিই। সন্ধ্যার পর পাক সেনা ক্যাম্প আক্রমণের রেকি করি। তার দেয়া তথ্যমতে, ৮/১০ জন পাক সেনা তখন ভারী অস্ত্রেশস্ত্রে ক্যাম্পে অবস্থান করছিল। আমরা গেরিলা যোদ্ধা তাই আক্রমণগুলো সাধারণত রাতেই হত। রাত ১২টার পর পাক সেনা ক্যাম্পের আশপাশে অবস্থান নিতে শুরু করি।শহীদ হন সাহাব উদ্দিন নিহত হয় চার রাজাজাকার ও এক পাকি সেনা।
মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মফিজুল ইসলাম বলেন, ৭ ডিসেম্বর ভোর চারটায় ফায়ারের শব্দ শোনার পর পাকিস্তানী ক্যাম্পে আক্রমণ করা হয়। পরদিন সকাল সাতটা পর্যন্ত মুহুর্মুহু গুলির শব্দে আশপাশ প্রকম্পিত হয়ে উঠে। মুক্তিযোদ্ধারা দুই দিক থেকেই পাকি সেনাদের ওপর আক্রমণ করতে থাকে। চলতে থাকে গুলি বিনিময়। শ্রীপুরের খোঁজেখানী এলাকার বাসিন্দা ও গোসিঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র সাহাব উদ্দিন ছিল রেলসেতুর পূর্ব পাশে থাকা দলের সামনের সারিতে। গুলি বিনিময়ের একপর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে সাথে সাথেই মাটিতে পড়ে মৃত্যুর কূলে ঢলে পড়ে শহীদ হন সাহাব উদ্দিন। নিহত হয় একজন পাকিস্তানী সেনাসহ চার রাজাকার। এদিকে, পাকি সেনারা তাদের ক্যাম্পগুলোতে দিনের বেলা সাধারণত কম সেনা মজুদ রাখত। পাকি ক্যাম্পের বাবুর্চি তমিজ উদ্দিনের দেয়া পাক সেনা ক্যাম্পে সৈন্য সংখ্যা বাড়ানো কমানোর সময়ের তথ্যটি আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। ফলে টানা তিন ঘণ্টা সম্মুুখ যুদ্ধ শেষে পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী পাশের গ্রাম ডোয়াইবাড়ী এলাকার আব্দুস সোবাহানের বাড়ির উদ্দেশ্যে সবাই রওয়ানা হয়। ওইদিন বিকেলে আব্দুস সোবাহানের বাড়িতে সমবেত হয়ে দেখি সবাই রয়েছি নেই শুধু সাহাব উদ্দিন। ঘটনার পরদিন ৮ নভেম্বর পাকিস্তানী সেনারা তাদের ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায়। ১২ ডিসেম্বর রাজাকার ও শত্রুমুক্ত হয় শ্রীপুর।
সম্মুখ যুদ্ধের অপর এক মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হারুন- আল- রশিদ বলেন, ধান গাছের আঁটি দিয়ে পাকিস্তানী ক্যাম্প ও সেতু সাজিয়ে ৬ ডিসেম্বর রাতেই প্রশিক্ষণ নিই। ৭ ডিসেম্বর ভোর চারটায় ইজ্জতপুরে অপারেশনে রেলসেতু ধ্বংস করা হয়। এরপর থেকেই পাকিস্তানী সেনারা শ্রীপুরের বিভিন্ন ক্যাম্প ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশে যাওয়া শুরু করে। সর্বশেষ ১২ ডিসেম্বর সম্পূর্ণরূপে রাজাকার ও হানাদারমুক্ত হয় শ্রীপুর।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিন জানান, ওই দিন মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনে হানাদার বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পরে। ১১ ডিসেম্বর রাতেই আস্তে আস্তে হানাদার বাহিনী শ্রীপুর ছাড়তে শুরু করে। ১২ ডিসেম্বর ভোরে শ্রীপুর সম্পূর্ণ রূপে পাক-হানাদার মুক্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পরে। ১২ ডিসেম্বর সকালে শ্রীপুর হাসপাতালের সামনে প্রথম পত পত করে উড়ে স্বাধীন বাংলার লাল সবুজের পতাকা।
« আলহাজ্ব সামছ উদ্দীন আহম্মেদের মৃত্যুতে শোকের ছায়া (পূর্বের খবর)
(পরের খবর) জরুরী বিজ্ঞপ্তি »