সম্প্রচার মাধ্যমের সবার জন্য আইনি সুরক্ষায় একসাথে কাজ করতে হবে — তথ্যমন্ত্রী

ঢাকা, ৮ কার্তিক (২৪ অক্টোবর) : ‘সম্প্রচার মাধ্যমের সবার জন্য আইনি সুরক্ষায় একসাথে কাজ করতে হবে’ বলেছেন তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহ্মুদ। মন্ত্রী বলেন, ‘দেশে সম্প্রচার নীতিমালা হয়েছে। সম্প্রচার আইন যদি আমরা পাস করতে পারি, সে আলোকে সম্প্রচার মাধ্যমের কর্মীদের চাকুরি সুরক্ষা হবে। এছাড়া নবম ওয়েজবোর্ডে স্পষ্ট বলা আছে, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের জন্য একটি আলাদা নীতিমালা করতে হবে। আমি মনে করি নবম ওয়েজবোর্ডের সুপারিশের আলোকে একটি নীতিমালাও করা প্রয়োজন, যাতে করে
ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার শ্রমিক, কর্মচারী, সাংবাদিক সবার জন্য আইনি সুরক্ষা থাকে।
সে লক্ষ্যে আপনাদের সাথে নিয়ে আমি কাজ করবো। সম্প্রচার আইন ও গণমাধ্যমকর্মী আইন নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। আশা করি, খুব সহসা আইনটি মন্ত্রিসভা হয়ে পার্লামেন্টে নিয়ে যেতে পারবো।’ আজ দুপুরে রাজধানীর কাকরাইলে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) সেমিনার হলে বেসরকারি টেলিভিশন সাংবাদিকদের সংগঠন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার-বিজেসি আয়োজিত ‘সম্প্রচার মাধ্যমের সংকট’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় মন্ত্রী একথা বলেন। ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের আহ্বায়ক রেজওয়ানুল হক রাজার সভাপতিত্বে ও মহাসচিব শাকিল আহমেদের সঞ্চালনায় পিআইবি মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে’র প্রেসিডেন্ট মোল্লা জালাল, একাত্তর টিভি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল হক বাবু, ডিবিসি২৪ টিভি চ্যানেলের চেয়ারম্যান ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বিশিষ্ট সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, মুন্নী সাহা, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজে’র সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ খোলামেলা আলোচনায় অংশ নেন।
এ সময় তথ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমের মালিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘সাংবাদিকদের বঞ্চিত করবেন না। সময়মতো বেতন পরিশোধ করবেন। কারণ গণমাধ্যমকর্মীরা অনেক কষ্টে কাজ করেন। তাদের এ কষ্ট সবার অনুধাবন করা প্রয়োজন।’ড. হাছান বলেন, ‘আপনারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিশ্চয়ই সাধুবাদ দেবেন কারণ তাঁর হাত ধরেই এই প্রাইভেট টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৬ সালে তিনি যখন সরকার গঠন করেন তখনই তিনি প্রথম প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্স দেন। সম্প্রচার মাধ্যম অর্থাৎ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বাংলাদেশে গত ১১ বছরে তিন গুণের চেয়ে বেশি বেড়েছে।
২০০৯ সালে যখন মাননীয়প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয়বার ক্ষমতা নেন, তখন বাংলাদেশে টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা ছিল ১০টি। এখন টেলিভিশনের সংখ্যা সম্প্রচারে আছে প্রায় ৩৪টি, আমরা লাইসেন্স দিয়েছি ৪৫টিকে। অর্থাৎ আরো কিছু সম্প্রচারে আসবে। আমি মন্ত্রণালয়ে যে সমস্যাগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি সেগুলো সমাধানের জন্য প্রথম থেকেই চেষ্টা করেছি। দীর্ঘদিনের পূঞ্জিভুত সমস্যা হঠাৎ করে সমাধান করে দেয়া যায় না, একটু সময় প্রয়োজন।’
‘এরপরও অনেক সমস্যা ইতোমধ্যেই সমাধান হয়েছে’ জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘যেমন কেব্ল নেটওয়ার্কে টেলিভিশনের ক্রম ঠিক রাখার জন্যে বা উপরে নেওয়ার জন্য কেব্ল অপারেটরদের সাথে যে দেন-দরবার করতে হতো এবং দেন-দরবারের সাথে আরো অন্যান্য কিছুও করতে হতো। সেটি করে সিরিয়াল ঠিক করা হলো পরে আবার নামিয়ে দিতো, এখন সেই পরিস্থিতির সারাদেশে অবসান ঘটেছে।’ ‘দ্বিতীয়ত: টেলিভিশনে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন বিদেশে চলে যাচ্ছিল; উল্লেখ করে ড. হাছান বলেন, ‘বাংলাদেশে বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেখানো আইনসম্মত নয়, আইনবিরোধী। ডাউনলিংকের পারমিশন যারা পেয়েছে, তাদের সবাইকে আমরা চিঠি দিয়েছি, মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়েছে এবং বিদেশি চ্যানেলগুলোকেও তারা জানিয়েছে। এতে যেটি হয়েছে বাংলাদেশের যে বিজ্ঞাপন বিদেশি চ্যানেলে প্রচার হতো সেটি পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে। তবে, বাংলাদেশের কয়েকটি কোম্পানির ভারতেও কারখানা আছে, ভারতে রেজিস্ট্রারপ্রাপ্ত। ভারতের রেজিস্ট্রার্ড কোম্পানি যখন বিজ্ঞাপন দেয়, এটি আমাদের আওতায় পড়ে না। তবুও এ বিষয়ে আমরা ব্যাখ্যা চেয়েছি।’
মন্ত্রী বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছিল, সেটি তো আর যাচ্ছে না। এখন যারা মালিক পক্ষ নিশ্চয় জানেন ছয় মাস আগের তুলনায় টেলিভিশনগুলো অনেক ভালো চলছে। যেটা সিঙ্গাপুরে অন্য কোম্পানির মাধ্যমে চলে যেত, আর হুন্ডি হয়ে টাকা চলে যেত, সেটা বন্ধ হয়েছে। সুতরাং পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে। একটি পদক্ষেপ নেওয়ার পর কার্যকর হতে কয়েক মাস সময় লাগে।’
‘এখানে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে সম্প্রচার মাধ্যমে এখনো ডিজিটাল হয়নি, বেআইনি বিজ্ঞাপন বন্ধ বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় অন্তরায়। আমরা সম্প্রচার মাধ্যমকে ডিজিটাল করার জন্য কাজ করছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই সম্প্রচার মাধ্যমকে ডিজিটাল করা হবে। এর বাইরেও বিদেশি চ্যানেল যাতে ক্লিন ফিড দেয়, সেজন্য আরো সে চিন্তা-ভাবনাও আমাদের আছে। বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বিদেশি এই চ্যানেলগুলোর যেহেতু দর্শক তৈরি হয়েছে, আমরা যখন আইনের কড়াকড়ি করতে যাই, যারা এগুলো ডাউনলিংক করে এখানে সম্প্রচার করে তখন এই দর্শকদের কাজে লাগিয়ে তারা ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে। কিন্তু দেশের আইন বাস্তবায়ন করার জন্য আমরা বদ্ধপরিকর। যাতে দেশের আইন বাস্তবায়িত হয় সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।’
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের নাট্যকর্মীরা নাটক পায় না, বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনচিত্রে যারা অভিনয় করে তারা ঠিকমতো কাজ পাচ্ছে না, আমাদের দেশে ছেলেমেয়েরা অনেক স্মার্ট এবং তারা ভালো বিজ্ঞাপন বানায়। ইদানীং আমরা দেখতে পাচ্ছি কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে বিদেশি সিরিয়াল নিয়ে এসে ডাবিং করে সেগুলো সম্প্রচার করা হচ্ছে, এমনকি ত্রিশ বছরের পুরনো সিরিয়ালও। বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন বিদেশে বানিয়ে নেয়া হচ্ছে, অনেক ভালো ভালো শিল্পী থাকা সত্ত্বেও বিদেশে সেকেন্ড গ্রেডের শিল্পী দিয়ে সেগুলো বানিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এতে আমাদের ছেলেমেয়েরা বঞ্চিত হচ্ছে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি বঞ্চিত হচ্ছে। আমরা এ ব্যাপারেও উদ্যোগ নিয়েছি, এজন্য ট্যাক্স দিতে হবে। এ উদ্যোগ কেউ নেয়নি।’
ড. হাছান বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যেই বিদেশি সিরিয়াল প্রচারের ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি নিয়ে প্রচার করার জন্য পরিপত্র জারি করেছি। এবং যারা চালাচ্ছে তারা অনুমতি নিচ্ছে। যেখানে একটি সিনেমা সেন্সরবোর্ড অনুমতি নিয়ে আসতে হয়, সেখানে একটি সিরিয়াল যেটিতে ৫০ বা ১০০ পর্ব আছে, সেটি কি সরকারের কাছে একটি চিঠি দিলেই কি আমরা অনুমতি দিয়ে দিবো ? সে কিন্তু হওয়া সমীচীন নয়। সেজন্য আমরা একটি কমিটি করে দিচ্ছি খুব সহসা, সেন্সর বোর্ডে যেমন ছবি প্রদর্শন করতে হয় সেরকম এ কমিটির কাছে উপস্থাপন করতে হবে। কমিটি যদি মনে করে এটি আমার ভাষা, সংস্কৃতি কৃষ্টির সাথে যায়, দেশের জনগোষ্ঠী বিপদে পড়বে না অর্থাৎ সেন্সর বোর্ড যে বিবেচনায় একটি সিনেমা অনুমোদন দেয়, সেই বিবেচনাগুলো এবং রাষ্ট্রস্বার্থ, দেশের স্বার্থ, জনগণের স্বার্থ, জনগণের মনন তৈরি স্বার্থ, জনগণের মানসিকতা তৈরির স্বার্থ এগুলো বিবেচনা করে তারপর অনুমতি দেয়া হবে। এগুলো কিন্তু আগে হয়নি।’
মোবাইল অপারেটরদের উদ্দেশে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোকে শুধু কোম্পানি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করার জন্য লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে সেটিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অথবা অন্য মাধ্যমে সেটি প্রচার করা আবার সেখানে বিজ্ঞাপন নেওয়ার জন্য আবার টাকা নেওয়ার এই লাইসেন্স তো তাদেরকে দেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে আইন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি। এখানেও প্রচুর বিজ্ঞাপন চলে যায়। একজনের ডোমেইনে আরেকজনের আগ্রাসন করা সঠিক নয়। এটি আইন বহির্ভূত। এটি যাতে না হয়,
এখানে যাতে একটি পরিপূর্ণ শৃঙ্খলা আসে সেজন্য আমরা কাজ করছি।’
‘নবম ওয়েজবোর্ড ঘোষণা একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল’ উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘একটি মামলা হয়েছিল। মামলায় সরকারের ওপর রুল জারি হয়েছিল। এবং আমরা ওয়েজবোর্ড ঘোষণা করার কারণে আরেকটি মামলা হয়েছে। আইনি প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই সমস্ত চ্যালেঞ্জগুলোকে মাথায় নিয়েই এটি ঘোষণা করা হয়েছে।’ তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান বলেন, ‘আমি সবসময় মন্ত্রী থাকবো না, সুতরাং আমি আপনাদের একজন। আমি ছোটবেলা থেকে সংবাদকর্মী। আমাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি আপনাদের হয়ে, আপনাদের দৃষ্টিতে বিষয়গুলোকে দেখার চেষ্টা করি। এরপরও দায়িত্বে থাকলে সবপক্ষের কথা শুনতে হয়। সেখানে একটি ভারসাম্য তৈরি করতে হয়। এটিও আশা করি আপনারা অনুধাবন করবেন। এই কাজ যত চ্যালেঞ্জই হোক, আপনাদের সাথে নিয়ে এগিয়ে যাব, গণমাধ্যমের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে।’