মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর করার দাবী ’৭১ এর বীরঙ্গনা পাইকগাছায় গুরুদাসীর বাড়ি অরক্ষিত

এস,এম, আলাউদ্দিন সোহাগ, পাইকগাছা প্রতিনিধিঃ খুলনার পাইকগাছায় ১৯৭১’র বীরঙ্গনা গুরুদাসীর বাড়ীটি দীর্ঘ দিন যাবৎ অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বাড়িটি সংরক্ষণের অভাবে বখাটেরা তাদের আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বাড়িটি সংরক্ষণের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসী। সূত্র জানায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী গুরুদাসীর উপর নির্মম নির্যাতনের চালায় এবং তার চোখের সামনে স্বামী, পুত্র ও কন্যাকে হত্যা করে। স্বামী গুরুপদ মন্ডল ছিলেন পেশায় একজন দর্জী।
স্বাধীনতা কামী অত্যন্ত সহজ সরল মানুষ ছিলেন তিনি, তার স্ত্রীর উপর পাকদোসদের নির্মম অত্যাচারে বাঁধা দিলে তাকে এবং তার দুই পুত্র ও বড় কন্যাকে গুলি করে হত্যা করে তারা। গুরুদাসীর ছোট মেয়ে যখন মায়ের কোলে দুধ খাচ্ছিল তখন পাকদোসরা ছিনিয়ে নিয়ে কাঁদা মাটিতে পুতে মারে। গুরুদাসী অতি সুন্দরী হওয়ায় পাকদোসরা তার নিজ বাড়ীতে আটকে রেখে নির্যাতন চালাচ্ছিল। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এ খবর টের পেয়ে তাকে উদ্ধার করেন। কিন্তু তত ক্ষণে তিনি মানষিক ভার সাম্য হারিয়ে ফেলেন। উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নে স্বামী, পুত্র ও কন্যা মিলে ছিল তাদের সুখের পরিবার।
গুরুদাসী ছিলেন দু’পুত্র ও দু’কন্যা সন্তানের জননী। পাকদোসরদের লালসার শিকার গুরুদাসীকে ঐ সময় উদ্ধার করে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাছেই রাখেন। দেশ স্বাধীন হলে মানসিক ভারসাম্যহীন গুরুদাসীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাবনার মেন্টাল হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেও সেখান থেকে চলে আসেন তিনি। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে অবশেষে পাইকগাছার কপিলমুনিতে আসেন। উপজেলা তথা দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে মানুষের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় মাসী। ভিক্ষাই ছিল তার জীবন জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন। সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় লাঠি হাতে মানুষকে ভয় দেখানো, হাত পেতে দু’টো টাকা চাওয়া এই মানুষটিকে মৃত্যুর আগে চিনতো না এমন মানুষ খুব কম ছিল।
শুধু উপজেলায় নয় দেশে বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ তাকে চিনতেন। কারন তিনি এক দন্ড কোথাও বসতেন না। শুধু ছুটে বেড়াতেন বিভিন্ন অঞ্চলে। পাগল এই মানুষটি একটি কথা বেশি বলতেন “কবে তার স্বামী, সন্তানদের হত্যাকারীদের বিচার হবে”? তার নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট স, ম, বাবর আলী এবং নির্বাহী কর্মকর্তা (সাবেক সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব) মিহির কান্তি মজুমদার স্থানীয় কপিলমুনিতে সরকারী জায়গায় তার বসবাসের জন্য একটি বাড়ী তৈরী করে মাথা গোজার ঠাই করে দেন।
বীরঙ্গনা গুরুদাসী মানবতা জীবন যাপন করতে করতে ২০০৮ সালের ৮ ডিসেম্বর এ বাড়ীতেই মৃত্যু বরণ করেন। তার মৃত্যুর খবর শুনে সে সময় ছুটে আসেন এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা, প্রশাসন সহ সর্ব স্তরের মানুষ। সরকারী তালিকায় তার নাম না থাকায় সাধারণ মানুষের মত শেষকৃত্য অনুষ্ঠান করা হয়। তার বসবাসের বাড়ীটি এখন রাত-দিনে নেশাখোর ও অসামাজিক লোকদের আড্ডা স্থল হয়েছে। তার শেষ কৃত্য অনুষ্ঠানে গঠন করা হয়েছিল বীরঙ্গনা গুরুদাসী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ। ঐ সময় নেতৃবৃন্দ তার বসবাসের বাড়ীটি স্মৃতি যাদুঘর ও পাঠাগার তৈরীর ঘোষণা দেন। আজও অবধি তার কোন বাস্তবায়ন হয়নি। অযন্তে আর অবহেলায় পড়ে আছে গুরুদাসী মাসির স্মৃতি বিজড়িত বাড়ীটি।
স্থানীয় কয়েকজন জানান, একটি কূচক্রীমহল গুরুদাসীর বাড়ীটি দখলের পায়তারা চালাচ্ছে। বাড়ীটি সংরক্ষণের ব্যাপারে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট স.ম. বাবর আলী বলেন, গুরুদাসীর বাড়িটি লাইব্রেরী করার পরিকল্পনা ছিল। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অফিসার জুলিয়া সুকায়ানা বলেন, গুরুদাসীর স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর করার পরিকল্পনা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করতে বীরঙ্গনা গুরুদাসীর বাড়িটি সংরক্ষণ ও যাদুঘর করার দাবী জানিয়েছেন পাইকগাছাবাসী।