প্রধান মেনু

মাটির ব্যাংক তৈরি করে, অভাব কাটিয়ে সুখের হাতসানিতে কারিগরের সংসার

কালিয়াকৈর (গাজীপুর)প্রতিনিধিঃ বড় কোন বাণিজ্যক ব্যাংক নয়, টাকা-পয়সা জমানোর মাটি ব্যাংক তৈরি করে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার উল্টাপাড়া গ্রামের ৫০টি পরিবার সুখের সংসার গড়ে তোলেছেন। শিশু, নারীরাও বসে নেই, পুরুষদের পাশাপাশি তারাও তৈরি করছেন মাটির ব্যাংক। গত ২০ বছর ধরে এটিই তাঁদের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন। সেই সঙ্গে রয়েছে সচ্ছলতা ফিরে আসার আনন্দও।

গ্রামের সাধারণ মানুষ আগের দিনে ব্যাংকে গিয়ে টাকা না রাখতে পারলেও মাটির তৈরি ব্যাংক কিনে ঘরের এক কোণে অথবা খাটের নিচে রেখে তার মধ্যে টাকা পয়সা জমিয়ে রাখত। মাটির ব্যাংকটি এক সময় ভরে গেলে তা ভেঙে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করত। সেই মাটির ব্যাংকের প্রচলন এখনো থেমে নেই। কেউ শখের বসে কেউবা ঘরের শোভা বৃদ্ধির জন্য আবার কেউবা টাকা পয়সা জমানোর জন্য এখনো মাটির তৈরি করা ব্যাংক কেনেন। এখনো সেই মাটির ব্যাংকের প্রচলন আছে।

মৃৎশিল্পী কৃষ্ণ পাল জানান, এক সময় গ্রামের শীতল চন্দ্র পালসহ দুই-তিনটি পরিবার মাটির ব্যাংক তৈরির কাজ করত। হাতে কাজ না থাকায় তাদের দেখে এবং তাদের কাছ থেকে বিনা পয়সায় প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রায় ২০ বছর আগে উল্টাপাড়া গ্রামে এ কাজ শুরু হয়। তবে এ গ্রামে কাজটি প্রথম শুরু করেন শীতল চন্দ্র পাল। তিনি এ জন্য একটি এনজিও থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নেন। সহযোগিতার হাত বাড়ান তাঁর স্ত্রী অর্চনা পাল। তিনি (অর্চনা পাল) বলেন, ‘আগে এক বেলা খেলে আরেক বেলা খেতে পারতাম না। আর এখন সংসারে কোনো অভাব নেই।

একটি টিনসেট বাড়ি করেছি, ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পড়াচ্ছি।’ যেভাবে শুরু: প্রায় ২০ বছর অগে ওই গ্রামের শীতল চন্দ্র পাল ঢাকার সাভারের একটি বিদেশি মৃৎশিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। ওই প্রতিষ্ঠানে মাটি দিয়ে ব্যাংক, ফুলদানি, ফুলের টব, বসার মোড়াসহ নানা রকমের খেলনা তৈরি করা হতো। পরবর্তী সময়ে গ্রামের বেকার কয়েকজন যুবকের উৎসাহে শীতল পাল ঋণ নিয়ে একটি হুইল মেশিন (ব্যাংক তৈরির জন্য মাটি উপযোগী করার যন্ত্র) কিনে বাড়ির উঠানে বসান। শুরু হয় শীতল পালের ব্যাংক তৈরির কাজ। তাঁকে দেখে গ্রামের অনেক বেকার এ কাজ শুরু করেন। শীতল পাল তাঁদের প্রশিক্ষণ দেন বিনা পয়সায়। এভাবে
পুরো গ্রামেই পরিচিত হয় মাটির ব্যাংক তৈরির কাজ।

যেভাবে তৈরি হয়: গ্রামের পাশের খাল থেকে ২ হাজার টাকা দিয়ে এক ট্রাক মাটি ক্রয় করতে হয়। সেই মাটি এনে বেশ কয়েক দিন চাপা দিয়ে রাখা হয়। মাটি শুকিয়ে গেলে তা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে হাত ও পায়ের সাহায্যে আঠালো করা হয়। সেই মাটি পা-চালিত হুইল মেশিনের ওপর রেখে হাতের মাধ্যমে ডিজাইন করে তৈরি করা হয় ব্যাংক। ব্যাংক তৈরির পর তা কায়েক দিন পর্যন্ত রোদে শুকাতে হয়। শুকিয়ে গেলে তা চুল্লিতে দিয়ে পুড়াতে হয়। পুরা শেষ হয়ে গেলে প্রাথমিক পর্যায়ের এর কাজ শেষ।

পরে সেই মাটির ব্যাংকে রং দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইন করা হয়। বাজারজাত: বিভিন্ন আকারের ব্যাংকের দাম ভিন্ন। এর দাম নির্ধারণ করা হয়েছে কেজি হিসাবে। হাফ কেজি ব্যাংকের পাইকারী মূল্য ৯ টাকা, ১ কেজি ওজনের মূল্য ১০ টাকা, ২ কেজি ১৫, ৩ কেজি ৩৫ টাকা। তবে ৩ কেজি ওজনের বেশি তারা তৈরি করেন না।

প্রথম দিকে কারিগরেরা নিজেরাই উপজেলার বিভিন্ন বাজারসহ ঢাকায় নিয়ে ব্যাংক বিক্রি করতেন। পরবর্তী সময়ে মহাজনেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্যাংক কেনা শুরু করেন। মহাজনেরা কম দামে কিনে বিভিন্ন স্থানে বেশি বিক্রি করে এবং মহাজনেরা যে স্থানে তারা আবার আরো অনেক বেশি বিক্রি করে। ব্যাংকের পাইকার সাইফুল ইসলাম জানান, গ্রামে অনেকের পুঁজি নেই, অনেক সময় তাঁদের ঋণ দিয়ে সহাযোগিতা করা হয়। ঋণের বিনিময়ে অতিরিক্ত কোনো সুদ দিতে হয় না, তবে প্রতিটি মাটির ব্যাংকে ৫০ পয়সা দাম কম দেওয়া হয়।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কালিয়াকৈর উপজেলার ঢালজোড়া ইউনিয়নের উল্টাপাড়া এলাকায় ঢুকতেই রাস্তার উপরে এক পাশে শুকাতে দেয়া হয়েছে মাটির ব্যাংক। পাশে মোটরসাইকেল রেখে ওই এলাকায় প্রবেশ করতেই দেখা গেল শত শত মাটির কাচা ব্যাংক। এখনও শুকায়নি। প্রতিটি বাড়ির বারান্দায় বসানো হয়েছে হুইল মেশিন (ব্যাংক তৈরির জন্য মাটি উপযোগী করার যন্ত্র)।

সেই মিশিনের শব্দে বুঝা যাচ্ছে সবাই কর্মব্যস্ত। যারা ব্যাংক তৈরিতে ব্যস্ত তারা কারো যেন কথা বলার সময় নেই। কিছু জানতে চাইলে কাজও করছেন আবার কথাও বলছেন। মৃৎশিল্পী দয়ালপাল (৮৪) জানান, দিনে কমপক্ষে ১০০ মাটির ব্যাংক তৈরি করতে হবে। মহাজনের অর্ডার আছে। সময় মতো না দিলে পরবর্তীতে তারা আর কাজ দিতে চাইবে না। তবে মহাজনের অভাব নেই।

এখানে কাজেরও অভাব নেই। এই গ্রামের ৫০টি পরিবার ব্যাংক তৈরি করে। সবাই ব্যস্ত সবারই অর্ডার থাকে। আরেক বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় বিমলা বিশ্বাস ও তার ছেলের বউ লিপি বিশ্বাস মাটির ব্যাংকে রং লাগাচ্ছেন।রং লাগানের পর পলিথিন দিয়ে বিশেষ কায়দায় তা ডিজাইন করছেন। ডিজাইন করা শেষ হলে তাতে মাটির ব্যাংকের সৌন্দর্য ফুটে উঠছে। ওই গ্রামে মাটির ব্যাংক তৈরির প্রথম কারিগর শীতল পাল জানান, উল্টাপাড়া গ্রামে প্রায় ২০ বছর আগে তিনি ব্যাংক তৈরির কাজ শুরু করেন।

সে সময় তাকে দেখে দুই একটি বাড়িতে
মাটি দিয়ে ব্যাংক তৈরির কাজ শুরু হয়। ওই সময় অন্য কোনো কাজ না থাকায় আমাদের দেখে এবং আমাদের কাছ থেকে বিনা বেতনে কাজ করে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এ গ্রামের অন্যান্যরা। এখন যে আয় হচ্ছে তাকে খবু বেশি লাভবান না হলেও সংসার ভালো মতোই চলছে। তবে যাদের চালান বেশি আছে তাদের আয়ও বেশি হচ্ছে। তবে সরকার স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে মৃৎশিল্পকে আরো গতিশীল করার দাবি জানিয়েছেন ওই গ্রামের মৃৎশিল্প কারিগরিরা।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. মোজাম্মেল হক জানান, ওই সব এলাকার ৫০টি পরিবার মাটির ব্যাংক তৈরি করে সংসার চালায়। এই পেশার মধ্য দিয়ে তাদের গ্রামের মৃৎশিল্প টিকে আছে। এই মৃৎশিল্পীদের সরকারিভাবে অল্প সুদে যদি ঋণ দেয়া যায় তবে তাদের জন্য ভালো হতো। পেশাটিও টিকে থাকবে অনেক দিন ধরে। ঢালজোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘উল্টাপাড়া গ্রামের সবগুলি পরিবার কাজে ব্যস্ত থাকে।

এটা খুবই ভালো দিক। মাটির তৈরি ব্যাংক বিক্রি করে তারা সুখের সংসার করছে। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছে। অনেকেই আধাপাকা বিল্ডিং করেছে।