প্রধান মেনু

প্রবীণরা আমাদের সম্পদ -মুহাম্মদ ফয়সুল আলম

‘প্রবীণ’, উচ্চারণ করা মাত্র আমাদের চোখের সামনে যে-ছবিটা ভেসে ওঠে তাহলো একজন শুভ্রকেশধারী মানুষ যিনি বয়সের ভারে বা বার্ধক্যে জর্জরিত। কেউ কেউ বেশ অসহায় জীবনযাপন করে থাকেন। আমরা তাদের সম্মান মর্যাদা কতখানি দিয়ে থাকি জানি না, তবে অযত্ন অবহেলা ও উপেক্ষা সম্ভবত নিত্য সঙ্গী তাদের। মনে করে থাকি বৃদ্ধ আর ক’দিন বাঁচবে? তাঁর জন্য সময় দেবার দরকার কী? তাদের অস্তিত্ব বা উপস্থিতি প্রায়শ: উপেক্ষিত নয়তো দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায়।

পঁচাত্তোরোর্ধ্ব রিয়াজ মোল্লার আজ শরীরে শক্তি নেই। দৃষ্টিশক্তিও কম। জীবন সায়াহ্নে অনেক কিছুর জন্যই এখন সে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। পেশাগত জীবনে ছিলেন একজন চাকুরিজীবী। তিন ছেলে ও দুই কন্যা সন্তানের পিতা তিনি। ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের ঘরে নাতি-নাতনি হয়েছে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও কোথায় যেন তার অশান্তি। যখন যৌবন ছিল ছেলেমেয়েরা ছোটো ছিল তখন রিয়াজ মোল্লা ও তার স্ত্রী তাদের জীবনের সুন্দর সময়ের সেরা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তাদের মানুষ করতে।

আজ তারা ভালো আছে। সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আজ এই বয়সে এসে জীবনের হিসেবের খাতা খুলতে বসে কোথায় যেন গরমিল আছে বলে মনে হয় তার। যে মানুষটা একসময় প্রচণ্ড মনোবল নিয়ে সংসারের হাল ধরে ছিলেন, আজ সে সংসারেই তার অনাদর। নিজেদের সংসার ও সন্তান নিয়ে তারা এত ব্যস্ত থাকে যে বৃদ্ধ পিতার দিকে নজর দেওয়ার তাদের যেন সময় নেই। বর্তমান পৃথিবী এমন একটা সময় অতিবাহিত করছে যখন কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা এবং নির্ভরশীল বয়স্ক মানুষের সংখ্যা সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নয়নের ফলে জন্ম ও মৃত্যুহার কমে যাওয়ার সাথে সাথে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়া এর অন্যতম প্রধান কারণ।

কোন বয়স থেকে একজন ব্যক্তিকে প্রবীণ বলা হবে আন্তর্জতিকভাবে তা নির্ধারিত নেই। তবে বিশ্বব্যাপী সাধারণভাবে ৬০ বা তদুর্ধ্ব বয়সি ব্যক্তিকেই প্রবীণ হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ২০১৩-তে প্রণীত জাতীয় প্রবীণ নীতিমালাতেও ৬০ বা তদুর্ধ্ব বয়সি ব্যক্তিকেই প্রবীণ বলা হয়েছে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ থেকে ২০৩০ সাল অর্থাৎ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পৃথিবীতে সিনিয়র সিটিজেন বা প্রবীণ মানুষের সংখ্যা ৫৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৯০ কোটি থেকে ১৪০ কোটিরও বেশি হবে। এর মানে হচ্ছে ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি যুবকের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা উন্নত দেশগুলোর চেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই প্রবীণ জনগোষ্ঠীর চাপ এই দেশগুলোতেই বেশি পড়বে। ফলে বিশেষত স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ওপর চাপ বৃদ্ধি পেয়ে সার্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশেও প্রবীণদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের তথ্য মতে ২০১১ এ বাংলাদেশে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ১২ লক্ষ, যা ২০৬১ সাল নাগাদ প্রায় ৫ গুণ বেড়ে আনুমানিক ৫ কোটি ৫৭ লক্ষে উন্নীত হবে। সীমিত সম্পদ আর বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই প্রবণতা ভবিষ্যতে একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

আমাদের দেশের প্রবীণ ব্যক্তিদের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্যগত সমস্যা এবং অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা অন্যতম। আমাদের সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে অতীতে প্রবীণরা যৌথ পরিবারে সকলের কাছ থেকে সেবা ও সহায়তা পেতেন এবং এভাবেই তাদের সময় কেটে যেত। প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনসহ তাদের বেশি যত্ন নেয়ার একটি বিশেষ মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতির চর্চা ছিল। কিন্তু বর্তমান চিত্র ভিন্ন। এদেশেও বর্তমানে বেশিরভাগ পরিবারই একক পরিবার।

এখন আর যৌথ পরিবার তেমনটা দেখা যায় না। এটাও পরিবারে প্রবীণদের নিগৃহীত হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ। প্রবীণরা যদিও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সম্পত্তির অধিকারী, তবু সন্তানের কাছ থেকে যে উষ্ণতা তারা প্রত্যাশা করেন তা পান না। প্রবীণরা এক সন্তানের কাছ থেকে খারাপ ব্যবহার পাওয়ার পর আরেক সন্তানের কাছে যান। সেখানেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। আবার অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় সন্তান পেশাগত কারণে বা উচ্চশিক্ষার কারণে বাবা-মাকে ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমায়।

সেক্ষেত্রেও বাবা-মা একাকী, নিঃসঙ্গ, মমতাহীন এবং আত্মীয় পরিজনহীন জীবনই হয় তাদের একমাত্র সঙ্গী।  সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ধারায় প্রবীণরা প্রথমত নিজ পরিবারেই তাদের ক্ষমতা ও সম্মান হারাচ্ছেন এবং ধীরে ধীরে সমাজের সব কর্মকাণ্ড হতে বাদ পড়ছেন। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের প্রবীণদের বার্ধক্যজনিত সমস্যা আর চরম আর্থিক দীনতার কারণে তারা পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সকল ধরনের সেবা পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ফলে প্রবীণ এই জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছেন যা আগামীতে একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।