হারিয়ে যাওয়ার পথে মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী হাজারি গুড়
মানিকগঞ্জ (প্রতিনিধি) ঃ অসাধু কিছু গুড় ব্যাবসায়ীদের দাপটে আর অবাধে খেজুর গাছ নিধনের ফলে হারিয়ে যাওয়ার পথে দুইশত বছরের ঐতিহ্যবাহী হাজারি গুড়।
খোজ নিয়ে জানা যায় এক সময় মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার প্রায় শতাধিক গাছি ও শিবালয় উপজেলার ৩৫-৪০ জন গাছি হাজারি গুড় উৎপাদন করতেন। এখন সেই সংখ্যা কমে দাড়িয়েছে ১৫-২০ জনে। এই হাজারি গুড়ের কদর রয়েছে দেশের সিমানা পেরিয়ে বিদেশে। হরিরামপুরের ঝিটকা এলাকার গাছি মিনহাজ হাজারির নাম অনুসারে এই গুড়ের নাম করণ করা হয় হাজারি গুড় । কথিত আছে ইংল্যান্ডের রানী উপহার হিসেবে হাজারি গুড় পেয়ে প্রসংসা করেছিলেন এর। কিন্তু দেশ ও বিদেশে এই গুড়ের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্যেও কিছু অসাধু গুড় ব্যাবসায়ী গুড় তৈরির সময় রসের সাথে চিনি মিশিয়ে গুড় তৈরির করার কারনে হারাতে বসেছে হাজারি গুড়ের ঐতিহ্য। অন্যদিকে জ¦ালনি চাহিদা মেটাতে ইট ভাটা গুলোতে পোড়ানো হচ্ছে খেজুর গাছের লাকরি যার কারনে বিলুপতির পথে খেজুর গাছ। শীত মৌসুম শরু হওয়ার পরপরি খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের প্রস্তুতি নেন জেলার প্রায় দেড় শতাধিক গছি। তবে খেজুরের গুড় তৈরির সঙ্গে দের শতাধিক গাছি জড়িত থাকলেও হাজারি গুড় উৎপাদন করেন মাত্র ১৫-২০ জন গাছি। যার মধ্যে অধিকাংশ হরিরামপুর উপজেলায় ৩-৪ জন গাছ শিবালয় উপজেলায়। প্রতিদিন দুপুর থেকে সন্ধা পর্যন্ত খেজুর গাছে হাড়ি বাঁধা নিয়ে ব্যাস্ত থাকেন এই এলাকার গাছিরা। এর পর কুয়শাচ্ছন্ন ভোরে কন কনে শীতের মাঝে খেজুরের রস সংগ্রহ করেন । সেই রস জাল দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরী করা হয় হাজারি গুড়। ৫-৭ লিটার রস জ¦ালালে তৈরী হয় এক কেজি হাজারি গুড় জানান, একাধিক গাছি । শিবালয়ের টাওয়াখালী গ্রামের গাছি মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জানান, এ বছর প্রায় ৮০টি খেজুরের গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছেন। সবমিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২০-২৫ লিটার রস পেয়ে থাকেন তিনি। রস থেকে প্রতিদিন প্রায় ৪-৫ কেজি করে গুড় উৎপাদন করে থাকেন। প্রতি কেজি হাজারি গুড়ের বাজার মূল্য ৮০০-৯০০ টাকা। একই উপজেলার নয়াকান্দি গ্রামের গাছি মোঃ বারেক ভুইয়া জানান এ বছর ১০০টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছেন। গড়ে প্রতিদিন ৩০-৪০ লিটার রস সংগ্রহ করে থাকেন তিনি। এই রস থেকে প্রতিদিন ৭-৮ কেজি গুড় তৈরী করা যায়। কিন্তু অসাধু গুড় তৈরির কারিগর ও অসাধু ব্যাবসায়ীদের দাপটে আসল গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করা দুরসাধ্য হয়ে পড়েছে বলে জানান তিনি। কারন হিসেবে তিনি জানান প্রতি কেজি গুরের সাথে ৫-৭ কেজি পরিমান চিনি মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ভেজাল গুড় । একেতে চিনির দাম অনেক সাশ্রয়ী ও চিনি মেশানো গুড়ের রং অনেক উজ্জল হওয়ায় দেখতে হুবুহু হাজারি গুড়ের মত। যেখানে এক কেজি হাজারি গুড় তৈরি করতে উৎপাদন খরচ হয় সবমিলিয়ে ৬৫০-৭০০ টাকা আর এক কেজি ভেজাল গুড় তৈরি করতে উৎপাদন খরচ হয় ৮০-১০০ টাকা। ভেজাল গুড় ক্রেতারা সাশ্রয়ী দামে পাওয়াতে আসল গুড় বিক্রি করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই বাধ্য হয়ে তিনিও এ বছর রসের সাথে চিনি মিশিয়ে গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছেন। যার প্রতি কেজি বাজার মূল্য ২০০-২৫০ টাকা। হরিরামপুরের গাছি পাড়ার গাছি আলম হাজারি জানান খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে হাজারি গুড় তৈরি করা তাদের পূর্ব পুরুষদের পেশা । এক সময় এই পেশার সুদিন থাকলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তার অভাবে আর খেজুর গাছের সংখ্যা দিন দিন দ্রুত হ্রাস পাওয়াতে এই পেশার এখন দুর্দিন চলছে। এখন শুধু পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য রক্ষায় নামে মাত্র এ পেশায় রয়েছেন তিনি। একই উপজেলার ইতালি প্রবাসী লুৎফর রহমান জানান, তিনি প্রায় দুই যুগ ধরে ইউরোপের দেশ ইতালিতে বসবাস করছে॥ তাদের উপজেলার হাজারি গুড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ইউরোপের দেশ গুলোতে। ঝিটকার কলতা এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী মোঃ নজরুল ইসলাম জানান, ঝিটকার ঐতিহ্যবাহী হাজারি গুড়ের ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন । এছাড়া ভেজাল গুড় তৈরি প্রতিরোধে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সজাগ থাকতে হবে। এছাড়া বাড়ির আঙ্গিনায় ও আশে পাশেে পতিত জমিতে বেশি বেশি করে খেজুর গাছ রোপনের পরামর্শ দেন তিনি।
মোঃ সোহেল রানা
মানিকগঞ্জ (প্রতিনিধি)