‘ব্রাজিল বাড়ি’ এবং একজন দুর্নীতিবাজের মুখোশ উন্মোচন!
এবারের ফুটবল বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তারকা তিনিই ছিলেন। না, তিনি মাঠে ফুটবল খেলেন না, তবুও এই সময়টায় তিনি ছিলেন সুপারহিট একজন। তাকে নিয়ে অজস্র প্রতিবেদন হয়েছে পত্রিকায়, ব্রাজিল থেকে সাংবাদিক উড়ে এসেছেন তার সঙ্গে দেখা করতে, কথা বলতে। ন্রাজিলের রাষ্ট্রদূত স্বয়ং তার বাড়িতে গিয়েছেন, তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন অ্যাম্বাসীতে। এই লোকের নাম জয়নুল আবেদীন টুটুল, নিজের মালিকানাধীন সাততলা বাড়ীটা ব্রাজিলের পতাকার রঙে রাঙিয়ে বিশ্বকাপের আগে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন তিনি, বাড়ির নাম দিয়েছিলেন ‘ব্রাজিল বাড়ি’। দারুণ বাহবা পেয়েছিল তার এই ভিন্নধর্মী কীর্তিটা। ব্রাজিল বিশ্বকাপ জেতেনি এবার, তবে টুটুল জিতে নিয়েছিলেন ব্রাজিল ভক্তদের মন।
কিন্ত বিশ্বকাপ শেষ হবার সপ্তাহ দুয়েকের মাথায় জানা যাচ্ছে, এই বাড়ি করার টাকার পুরোটাই দুর্নীতি করে কামিয়েছেন টুটুল। একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হয়ে চাকুরীর তেরো বছরের মাথায় বিত্ত-বৈভবের ছোটখাটো পাহাড় বানিয়ে ফেলেছেন তিনি। টাকায় বাড়ি করেছেন, গাড়ি কিনেছেন, নারায়নগঞ্জের কয়েক জায়গায় জমি আছে তার নামে। নিজের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে তিনি গাড়ি ছাড়া যান না, এলাকার মসজিদ-মাদ্রাসায় বড় অঙ্কের টাকা দান করেন।
একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী এমন আলিশান জীবনযাপন কিভাবে করেন, সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন বেসরকারী টিভি চ্যানেল ‘চ্যানেল ২৪’ এর সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল ইমরান এবং সার্চলাইট টিম। সেখানেই বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য, যেগুলো শুনলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে উঠতে হয়!
নিজেকে ব্রাজিলের সমর্থক দাবী করা টুটুলের বিখ্যাত ব্রাজিল বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়বে গ্যারেজের দেয়ালে আঁকা ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়দের ছবিগুলো। দামী টাইলসে মোড়ানো পুরোটা মেঝে আর দেয়ালের অনেকটা অংশ। ঘরে ঢুকলে চোখ ধাঁধিয়ে যায় আভিজাত্যের প্রাচ্যুর্য্যে। দেয়ালের রঙেও ব্রাজিলের পতাকার রঙের ছাপ আছে। ঝাড়বাতি থেকে আসবাবপত্র, প্রত্যেকটা জিনিসই ভীষণ দামি। এসব দেখে-শুনেই বিশাল খটকা লাগে মনের ভেতরে।
জয়নুল আবেদীন টুটুল পড়াশোনা বেশীদূর করেননি। সেটা নিজে স্বীকার করতে না চাইলেও, চ্যানেল ২৪ এর ক্যামেরার সামনে ক্লাস ফাইভ-সিক্সের বেশি পড়ার কথা স্মরণ করতে পারলেন না তিনি নিজেই। রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বিপিসি’র অধীনে যমুনা অয়েলে গেইজার হিসেবে কাজ করেন তিনি, কাজটা মূলত তেল মাপা। পদবীটা চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর। তার কিনা সাততলা বাড়ি আছে, আছে গাড়ি আর জায়গা-জমিও!
টুটুলের বাবা ছিলেন যমুনা অয়েলের সিকিউরিটি গার্ড। খুব একটা অবস্থাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন না তিনি। চাকুরীরত অবস্থাতেই মারা গিয়েছিলেন, সেকারণে পরিবারের অবস্থা বিবেচনা করে তার ছেলে টুটুলকে চাকুরী দেয়া হয় যমুনা অয়েলে। অস্থায়ী একটা চাকুরী, নো ওয়ার্ক নো পে ভিত্তিতে দৈনিক ৫০/৫৫ টাকা বেতনে ক্যান্টিনবয় হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন টুটুল। সেই লোক এখন বাড়ি-গাড়ি-জায়গা জমি আর অঢেল টাকার মালিক! তাও চাকুরীতে ঢোকার মাত্র তেরো বছরের মাথায়। টুটুল কি তবে জাদুটাদু জানেন? নাকি তার কাছে টাকা ছাপানোর মেশিন আছে?
২০০৫ সালে চাকুরী স্থায়ী হয় টুটুলের। সেখান থেকেই টাকার পাহাড় গড়ার শুরু। টুটুল তখন তেলের রাজ্যে ঢুকে গেছেন, এটা এমনই এক জগত, যেখানে দুই নম্বরী করতে জানলে লক্ষ লক্ষ টাকা আপনাতেই এসে ধরা দেয় হাতে। টুটুল সেটা শিখে ফেলেছিলেন, কিংবা হয়তো চুরিবিদ্যাটা তার মধ্যে আগে থেকেই ছিল। একে ওকে ধরে আর জায়গামতো টাকা খাইয়ে কয়েক বছরের ভেতরে গেইজার হিসেবে পদোন্নতি পেলেন। এবার আর তাকে পায় কে! তেল মাপা তার কাজ, সেখানে উনিশ-বিশ করে প্রতিদিন অবৈধ উপায়ে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাতে শুরু করলেন টুটুল, মাসশেষে আয়ের পরিমাণ কোটি ছাড়িয়ে গেল! এখানে সেখানে পার্সেন্টেজ দিয়েও বড় একটা অংশ থেকে যেত তার কাছেই!
একবার সুনামগঞ্জে বদলীও করা হয়েছিল তাকে, কিন্ত ঠিকই সবকিছু ‘ম্যানেজ’ করে আবার নারায়ণগঞ্জে চলে এসেছিলেন টুটুল। রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে নিজের পছন্দমতো অস্থায়ী লোকজনকে তেল মাপার কাজে সহকারী হিসেবে রেখেছেন, তার চুরিদারী ধরার কেউ নেই। যাদের ধরার কথা তাদেরও মুখ বন্ধ করে দেয়া আছে। বাবার অকালমৃত্যুর বদৌলতে পাওয়া চাকরীটাকে সোনার হরিণ বানিয়ে সরকারী সম্পত্তি লুটে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ছেন টুটুল। সেই টাকায় বাড়ি করেছেন, বাড়ির রঙ করেছেন ব্রাজিলের পতাকার রঙের সঙ্গে।মিলিয়ে, অথচ ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তী পেলে বা রোনালদিনহোর নামটাই ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারেন না তিনি। ‘ব্রাজিল বাড়ি’ যে নিজের প্রচারণার একটা ধান্ধা ছাড়া কিছুই নয়, সেটা এই প্রতিবেদনটা দেখলে বুঝতে কষ্ট হয় না।
সাক্ষাৎকারে টুটুল জানিয়েছেন, এসব নাকি তার বিরুদ্ধে অন্য দলের সমর্থকেরা নিন্দা করে ছড়িয়েছেন! তিনি বাড়ি করেছেন পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে, আর ব্যাংক লোন নিয়ে। তার ভগ্নিপতিরাও নাকি তাকে সাহায্য করেছেন। অথচ তার গ্রামের লোকেরা জানিয়েছেন, এখানে ভিটেবাড়ি ছাড়া তাদের আর কোন পৈত্রিক সম্পত্তিই নেই, কোনকালে ছিলও না! ব্যাংক লোন তিনি নিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্ত ইউসিবি ব্যাংক থেকে নেয়া দশ বছর মেয়াদের বিশ লাখ টাকার ঋণটা তিনি এক বছর পরেই শোধ করে দিয়েছিলেন। তাহলে এত টাকা এলো কোথা থেকে? যে আলিশান বাড়ি তিনি বানিয়েছেন, ভেতরটা যেভাবে সাজিয়েছেন, তাতে গুলশান-বনানীর চেয়ে খরচ খুব একটা কম হয়েছে বলে দাবী করতে পারবে না কেউ। সেই টাকাটার উৎস কি?
টুটুলের মতো মানুষগুলো প্রতিটা মূহুর্তে দেশের সম্পদ লুটেপুটে খাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি করে অবৈধ সম্পত্তি অর্জন করছে, সেগুলো যত্রতত্র ব্যবহার করে আলোচনায় আসছে। ব্রাজিলের যে সাংবাদিক টুটুলকে নিয়ে প্রতিবেদন লিখতে এসেছিলেন, তিনি এক বাংলাদেশী ভক্তের ব্রাজিলের প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসা দেখে গেছেন। সেই ভালোবাসার আড়ালে যে কি নোংরা খেলা আর অন্ধকার অধ্যায় লুকিয়ে আছে, সেটা তিনি জানেন না। জানলে টুটুলের কিছুই হবে না, বাংলাদেশের নামটা ডুববে। টুটুলরা এভাবেই বাংলাদেশকে ডোবান, মানুষের ভালোবাসার সাথে প্রতারণা করেন।