বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সোনালি ব্যাগ উৎপাদন হবে
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পাট থেকে পলিথিন (জুটপলি) উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করতে যুক্তরাজ্যের একটি বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি)। মঙ্গলবার (২ অক্টোবর) সচিবালয়ে পাট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম এবং পাট মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ফয়জুর রহমান চৌধুরীর উপস্থিতিতে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। পাট মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বিজেএমসি’র পক্ষে বিজেএমসি’র সচিব একেএম তারেক এবং যুক্তরাজ্যের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফুটামুরা কেমিক্যালের পক্ষে কোম্পানিটির জেনারেল ম্যানেজার প্রিমি কোউলহার্ড সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এ সময় বিজিএমসির চেয়ারম্যান ড. মাহামুদুল হাসান, বিজেএমসির বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ড. মোবারক আহম্মেদ খান, অপারেশন ম্যানেজার অ্যান্ডিউ জেমস ডাক এবং পাট থেকে পলিথিন তৈরির উদ্ভাবক ড. মোবারক হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে মির্জা আজম জানান, আগামী ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে পাট থেকে পলিথিন উৎপাদন শুরু হবে। প্রথমদিকে স্বাভাবিক পলিথিনের তুলনায় এই পলিথিনের ব্যাগের দাম কিছুটা বেশি হবে। তবে উৎপাদন বাড়লে দামের সমন্বয় হয়ে যাবে। বর্তমান সরকার কাঁচা পাট ও বহুমুখী পাটজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিকরণ, পাটজাত পণ্য রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বৃদ্ধিকরণ এবং পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন বর্জন ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে। পাটকে বিশ্ব বাজারে তুলে ধরতে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) এ ২৩৫ প্রকার পাটপণ্যের স্থায়ী প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র চালু হয়েছে। পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যবহার বহুমুখীকরণ ও উচ্চমূল্য সংযোজিত পাটপণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে চারকোল, ভিসকোস, পাটপাতার পানীয়সহ নতুন নতুন বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে জোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি জানান, পাট থেকে তৈরি এই পলিথিন ব্যাগের নাম হবে ‘সোনালি ব্যাগ’। এটি প্রধানমন্ত্রীর নিজের পছন্দের করা নাম। সারাবিশ্বে এই নামেই পরিচিত হবে পাটের তৈরি পলিথিনের ব্যাগ। আমরা যখন সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করি তখন পাট থেকে উৎপাদিত পণ্যের সংখ্যা ছিল ৩৫টি। বর্তমানে পাট থেকে উৎপাদিত পণ্যের সংখ্যা ২৮৫টি। এক সময়ের গোল্ডেন ফাইবার (সোনালি আঁশ) হিসেবে পরিচিত এই পাট ভবিষ্যতে গোল্ডেন বার (সোনার বার) হিসেবে পরিচিত হবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী জানান, বাজারে সোনালি ব্যাগের চাহিদা ব্যাপক হবে। আমরা যদি প্রতিদিন ৫০০ টন সোনালি ব্যাগ উৎপাদন করতে পারি তাহলে ৫০০ টনই বাজারজাত করা সম্ভব। পাট থেকে পলিথিন তৈরির উদ্ভাবক মোবারক হোসেন বলেন, এই সোনালি ব্যাগ পরিবেশবান্ধব এবং পুনরায় উৎপাদনে সক্ষম।
সভায় জানানো হয়, বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর আবিষ্কৃত পলিথিনের বিকল্প পচনশীল সোনালি ব্যাগ দেখতে প্রচলিত পলিথিনের মতোই হালকা, পাতলা ও টেকসই। পাটের সুক্ষ্ম সেলুলোজকে প্রক্রিয়াজাত করে এ ব্যাগ তৈরি করা হয়েছে। পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ মাটিতে ফেললে তা মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। ফলে পরিবেশ দূষিত হবে না। এই ব্যাগ দামে সাশ্রয়ী হবে। এভাবে পাটের ব্যবহার বাড়লে ন্যায্য দাম পাবেন কৃষক। অতীতের মতোই, বাংলাদেশ পাট দিয়েই বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত হবে।
বর্তমানে বিজেএমসির উদ্যোগে একটি ম্যানুয়েল পাইলট প্ল্যান্ট দিয়ে সোনালি ব্যাগ তৈরির কাজ করছে। তবে বৃহৎ পরিসরে নতুন উদ্ভাবিত সোনালি ব্যাগ তৈরিতে দেশে বা বিদেশে কোন মেশিন তৈরি হয়নি। তাই এ ধরনের মেশিন তৈরির জন্য বিভিন্ন দেশে যোগাযোগ করা হয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে দেশীয় প্রযুক্তিতে মেশিন তৈরি করা হয়েছে। এতে প্রতিদিন ৩-৪ হাজার পলিব্যাগ উৎপাদন করা সম্ভব হয়। প্রকল্পটি সফলভাবে পরিচালিত হওয়ায় দ্রুত বাণিজ্যিকভাবে এই পলিব্যাগের উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।
জানা গেছে, পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব পলিব্যাগ তৈরির উদ্দেশ্যে পাট থেকে সেলুলোজ আহরণ করা হয়। ওই সেলুলোজকে প্রক্রিয়াজাত করে অন্যান্য পরিবেশবান্ধব দ্রব্যাদির মাধ্যমে কম্পোজিট করে এই ব্যাগ তৈরি করা হয়। উৎপাদিত ব্যাগে ৫০ শতাংশের বেশির ভাগ সেলুলোজ বিদ্যমান। তাছাড়া এতে অন্য কোন প্রকার অপচনশীল দ্রব্য ব্যবহার হয় না বিধায় এটি দুই থেকে তিন মাসের মধ্যেই সম্পূর্ণরূপে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। আবিষ্কৃত এই ব্যাগের ভার বহন ক্ষমতা পলিথিনের প্রায় দেড়গুণ এবং এটি পলিথিনের মতোই স্বচ্ছ হওয়ায় খাদ্য দ্রব্যাদি ও গার্মেন্টস শিল্পের প্যাকেজিং হিসেবে ব্যবহারের খুবই উপযোগী। তাছাড়া দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করায় এই ব্যাগের দাম প্রচলিত পলিথিন ব্যাগের কাছাকাছিই থাকবে। পাট থেকে আবিষ্কৃত পচনশীল পলিব্যাগ এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়া এই ধরনের প্যাকেজিংয়ের বিদেশেও অত্যন্ত চাহিদা রয়েছে।
উল্লেখ্য, পলিথিনের বিকল্প পচনশীল সোনালি ব্যাগ তৈরির প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয় ১২ মে ২০১৭। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি)’র তত্ত্বাবধানে পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ উদ্ভাবন করেছে। উদ্ভাবিত সোনালি ব্যাগ পাইলট প্রকল্প পর্যায়ে উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান বিজেএমসি। রাজধানীর ডেমরায় অবস্থিত লতিফ বাওয়ানী জুটমিলে সোনালি ব্যাগ তৈরির প্রাথমিক পাইলট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়।