বছরে সাগর পথে অবৈধভাবে বিদেশ যাত্রা ঝিনাইদহে চারটি ইউনিয়নের ১৯ যুবক নিখোজ, পরিবারের মাঝে আহাজারি ॥
শামীমুল ইসলাম শামীম, ঝিনাইদহ প্রতিনিধি : কর্মসংস্থান ও উন্নত জীবন লাভের আশায় বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী দালাল সিন্ডিকেটের প্ররোচনায় সাগর পথে অবৈধভাবে বিদেশে গিয়ে ৬ বছরে নিখোঁজ রয়েছেন ঝিনাইদহের চারটি ইউনিয়নের ১৯ জন যুবক। ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে গিয়ে দালালদের খপ্পড়ে পড়ে এ সব যুবক নিখোঁজ হয়।
এখন তাদের পরিবারগুলোর মাঝে অন্ধকার নেমে এসেছে। কোথায় আছে, কীভাবে আছে
কোন খোঁজ খবরই মিলছে না তাদের। বেঁচে আছে কি-না তাও বলতে পারছেন না কেউ। পরিবারের মাঝে এখনও চলছে আর্তনাদ আর আহাজারি ।স্বজনদের অবিরাম আর্তনাদে চোখের জলও শুকিয়ে যাচ্ছে। তারপরও তাদের ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনছেন স্বজনরা। এলাকার বেশ কয়েকজন আদম ব্যাপারি দালাল সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে তারা।
কঠোর আইন, জীবনের ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা কোনো কিছুই যেন অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়া বন্ধ করতে পারছে না ঝিনাইদহের পুলিশ বিভাগ। ধরা ছোয়ার বাইরে দালাল সিন্ডিকেট।
সুত্রমতে, নিখোজদের মধ্যে একজনের স্ত্রী হলো শেফালি বেগম। কান্না থামছে না এখনও তার। চোখের পানি ঝরতে ঝরতে এখন তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তবুও এখনও পথ চেয়ে বসে আছেন স্বামী লাল চাদের ফেরার অপেক্ষায়।
বাড়ি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গাড়ামারা গ্রামে। মোজাহিদ ও মোস্তাক নামের দুই ছেলে নিয়ে তার
সংসার। সংসারের অভাব অনটন কুরে কুরে খায় তাদের। একটু সুখের আশায় স্বামী
লাল চাদ স্থানীয় দালালের খপ্পরে পড়ে অবৈধভাবে সাগর পথে মালেশিয়া যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়। আর কথা হয়নি স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে। ২০১৩ সালের শেষের দিকে নিখোজ হওয়ার পর একে একে ৬টি বছর পার হয়ে গেছে। দেখা হওয়া তো দুরের কথা।
আর কোনদিন কথা হবে কিনা তাও জানে না শেফালি বেগম। তার পরও স্বামী ও দুই
ছেলে অপেক্ষার প্রহর গুনছে।শুধু শেফালি বেগমের স্বামী নয়, এ ভাবে তার মতো করে নিখোঁজ রয়েছে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার চারটি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের ১৯ জন মানুষ। তাদের কারোরই কোন সন্ধান নেই। প্রতিটি পরিবারের একই অবস্থা। সচ্ছলতার
পরিবর্তে ক্ষুধা আর দারিদ্র্য নিত্যদিনের সঙ্গী তাদের। এখন সবাই অপেক্ষায় আছে
তাদের ফিরে আসার। নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে সদর উপজেলার হলিধানি ইউনিয়নের
রামচন্দ্রপুর গ্রামের ৩জন তারা হলো আব্দুল হামিদ,লাবলুর রহমান জিতু, আরাফাত
রিপন হোসেন, একই ইউনিয়নের গাড়ামারা গ্রামের ৮ জন,তারা হলো রিপন
হোসেন, ফরিদ হোসেন, আবু বক্কর, নাজমুল হক, লাল চাদ, মাসুদ রানা মবু,
আলমগীর হোসেন, অলিয়ার রহমান, ফুরসন্ধি ইউনিয়নের মিয়াকুন্ডু গ্রামে ৪ জন,
তারা হলো ইউনুচ আলী,বাবু জোয়ারদার, বিপুল জোয়ারদার,ওলিয়ার রহমান ও
ঘোড়শাল ইউনিয়নের পিরোজপুর গ্রামে ৩ জন তারা হলো তারিক মন্ডল, উলাফত মন্ডল,
শহিদুল ইসলাম ও মধুহাটি ইউনিয়নের মহামায়া গ্রামের ১ জন তিনি হলো জালাল
উদ্দিন রয়েছেন।
নিখোজের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, সদর উপজেলার রাধাকান্তপুর গ্রামের
আদম ব্যাপারি পিকুল হোসেন দীর্ঘদিন ধরে পানি পথে এ অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে
যাচ্ছে। সে এলাকার অনেক যুবকদের পাঠিয়েছে তার পরে এখনও তাদের কোন সন্ধান
পাওয়া যায়নি। রিপন হোসেন এ দালালদের মাধ্যমে গিয়ে এখনও নিখোজ রয়েছে।
দালাল পিকুলের একটি বড় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করে থাকে বলে
তারা আরও অভিযোগ করেন। যার কারনে নিখোজের অনেকেই তাদের বিরুদ্ধে মামলা
করার সাহস পাই না। তাদের মধ্যে বাবা গোলাম রসুল ছেলে রিপনের ফেরত পেতে তারা
ঝিনাইদহ র্যাবের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
তবে স্থানীয় এলাকাবাসি ও কুমড়াবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফ হোসেন
জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে সাগর পথে এলাকার দালাল পিকুল হোসেন
সহ, কুমড়াবাড়িয়ার টিটু হোসেন, রামনগর গ্রামের সাত্তার, নাটাবাড়িয়া
গ্রামের আবুল কালামসহ একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট রয়েছে। এরা কম টাকায়
এলাকার যুবকদের প্রলোভন দেখিয়ে মালেয়েশিয়া, সৌদি, কাতার, ইরান, দুবাইসহ
বিভিন্ন দেশে আদম ব্যবসা করে চলেছে। জড়িত আদম ব্যাপারিদের বিরুদ্ধে তদন্ত
পুর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। পুলিশ বলছে, অভিযোগের ভিত্তিতে
তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা।
এ বিষয়ে দালাল সিন্ডিকেটের প্রধান হোতা পিকুল হোসেন ও টিটু মোবাইল
ফোনের মাধ্যমে জানান, তারা অবৈধ পানি পথের এ ব্যবসা করেন না বলে অস্বীকার
করেছেন। তারা বিদেশে লোক পাঠান না বলে দাবি করেন।
এলাকাবাসি আরও জানিয়েছে, তারা এ অবৈধভাবে মানুষ বিদেশে পাঠানোর
ব্যবসা দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসছে। প্রশাসন ব্যবস্থা না নিলে দিন দিন
নিখোজের তালিকা আরো বড় হতে পারে বলে ধারনা করছেন এলাকাবাসি।
তবে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে পুলিশ সুপার মোঃহাসানুজ্জামান পিপিএম জানান,
এ মানব পাচার ও অবৈধভাবে যারা যুবকদের সাগর পথে বিদেশে পাঠিয়েছে তাদের
বিরুদ্ধে তদন্তপুর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারা যত ক্ষমতাশালী হোক না কেনো
অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের আটক করা হবে।
সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুশিয়ারি দেন।
অপরদিকে সদর থানার ওসি মিজানুর রহমান খান জানিয়েছেন, দালাল সিন্ডিকেট
সদস্যরা যেখানেই থাকুক না কেনো তাদের খুজে বের করে আইনের মাধ্যমে শাস্তির
ব্যবস্থা করা হবে। এ দিকে ঝিনাইদহ র্যাবের কোম্পানী কমান্ডার মাসুদ আলম জানিয়েছেন, রিপন নিখোজ হয় পানি পথে। তার পরিবার একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে। সেটি তদন্ত করে অচিরেই দালাল সিন্ডিকেটের প্রধান হোতাদের গ্রেপ্তার করা হবে।