জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে শঙ্কায় কোটি নাগরিক
দেশের এক কোটি নতুন ভোটারের হাতে লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্র তুলে দেয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন ভোটারের হাতে কার্ড তুলে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত তা প্রস্তুত করা হয়নি। নির্বাচন কমিশন (ইসি) এই ঘোষণা দিয়েছিল।২০১২ সালের পর যেসব নাগরিক ভোটার হয়েছেন, তাদের কয়েকজন বাদে বাকিরা স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র (স্মার্ট কার্ড) অথবা লেমিনেটেড কার্ড কোনোটিই পাননি। এসব ভোটারের জন্য একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৯৩ লাখ লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্র প্রিন্টিং করলেও ওইসব কার্ড মানসম্মত হয়নি জানিয়ে তা গ্রহণ না করার সুপারিশ করেছে নির্বাচন কমিশনের এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি।
এমন পরিস্থিতিতে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ বাতিল করা হবে নাকি ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব কার্ড পুনরায় প্রিন্ট করা হবে, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে কমিশন। এতে কবে নতুন ভোটাররা কার্ড পাবেন, তা নিশ্চিত কেউ বলতে পারছেন না।আবেদন করার পর বছরের পর বছর পার হলেও জাতীয় পরিচয়পত্র না পেয়ে অনেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা ও মোবাইল ফোনের সিম রেজিস্ট্রেশনসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারছেন না। নানা অসুবিধা ও ভোগান্তির মধ্যে তাদের পড়তে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র যাদের দেয়া হয়নি, তাদের আপাতত লেমিনেটেড কার্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে নতুন কার্ডগুলো মানসম্মত হয়নি বলে তিনি শুনেছেন। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক আবদুল বাতেন বলেন, ৯৩ লাখ লেমিনেটেড কার্ড প্রিন্ট করা হয়েছে। ওইসব কার্ডের মান ভালো পাওয়া যায়নি।
এছাড়া নির্দিষ্ট সময়ে ওইসব কার্ড সরবরাহ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হয়েছে। সব বিবেচনায় এসব কার্ড গ্রহণ না করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সুপারিশ করা হয়েছে। ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনসহ বেশকিছু এলাকায় স্মার্ট কার্ড বিতরণ করা হয়েছে। তাদের মতে, দেশের ৯ কোটির বেশি মানুষের হাতে স্মার্ট বা লেমিনেটেড কার্ড রয়েছে। বর্তমানে ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ১৮ লাখ। এ হিসাবে এক কোটির বেশি নাগরিকের হাতে জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। এ কার্ড না থাকায় তারা মোবাইল ফোন সিম নিবন্ধন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলাসহ নানা সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এ নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকায় কমিশন লেমিনেটেড কার্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থ সহায়তায় ৯৩ লাখ জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করতে স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি লিমিটেডকে কার্যাদেশ দেয় ইসি। এতে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৯ কোটি টাকা।৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ওই প্রতিষ্ঠানকে এসব কার্ড সরবরাহের কথা থাকলেও তারা মার্চে সরবরাহ করে। কিন্তু কার্ডের গুণগতমান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক আবদুল বাতেনকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়। সম্প্রতি ওই কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, এসব কার্ডের মান ভালো নয়। এগুলো গ্রহণ না করারও সুপারিশ করা হয়েছে। ওই কমিটির রিপোর্টে বলা হয়- নিম্নমানের কাগজে এসব কার্ড প্রিন্ট করা হয়েছে।
এতে ১৫০ জিএসএম (গ্রামস পার স্কয়ার মিটার) মানের কাগজ দেয়ার কথা থাকলেও কিছু কার্ড ১০০ জিএসএম কাগজে প্রিন্ট করা হয়েছে। আবার কিছু কিছু কার্ড ১২০, ১৩০ ও ১৫০ জিএসএম কাগজে প্রিন্ট করা হয়েছে। ওই কার্ডের লেমিনেটিংয়ে যে পেপার (পাউস) ব্যবহার করা হয়েছে তা নিম্নমানের। চুক্তিতে নতুন প্রিন্টার ও লেমেনেটিং মেশিনে কাজ করার কথা থাকলেও পুরনো মেশিনে কাজ করেছে কোম্পানিটি। সংশ্লিষ্টরা জানান, টেন্ডারে কার্যাদেশ দেয়ার ক্ষেত্রেও বেশি দর ধরা হয়। এ টেন্ডারে তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্রিয়েটিভ বাংলাদেশ নামে প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন ৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা দর উদ্ধৃত করলেও জাল কাগজপত্র দেয়ায় প্রতিষ্ঠানটি নন-রেসপনসিভ করা হয়।
অপর প্রতিষ্ঠান এমএন মল্লিক অ্যান্ড কোম্পানি ৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা দর উদ্ধৃত করলেও ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ওই পরিমাণ কার্ড সরবরাহ করতে পারবে না বলে এক মাস সময় চেয়েছিল। তবে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করার শর্তে স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি কোম্পানি নামের প্রতিষ্ঠানকে বেশি দরে কাজ দেয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ডিসেম্বরের পরিবর্তে মার্চে কার্ড সরবরাহ করে। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের একজন কর্মকর্তা একগুচ্ছ কার্ড দেখিয়ে বলেন, নতুন প্রিন্ট করা কার্ডের মান এতই খারাপ যে, অনেক কার্ডে ভোটারের কোনো তথ্য নেই।
আবার অনেক কার্ডের লেমিনেটিং হয়নি। কিছু কিছু কার্ডের লেমিনেটিং আংশিক হওয়ায় ভেতরের কাগজ বেরিয়ে আসছে। তিনি বলেন, এসব কার্ড মাঠপর্যায়ে বিতরণ করা হলে ইসি সমালোচনার মধ্যে পড়বে। এ বিষয়ে স্মার্ট টেকনোলজিসের ডিজিএম জাহাঙ্গীর হোসাইন বলেন, আমরা যেসব কার্ড সরবরাহ করেছি তার ২০ শতাংশের মান খারাপ হয়েছে, তা আমরা স্বীকার করে আসছি। আমরা বলেছি, ওইসব কার্ড বাছাই করে নতুন করে প্রিন্ট করে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছি।
তিনি বলেন, মানসম্মত কার্ড দিতে না পারার অভিযোগ এনে আমাদের কার্যাদেশ বাতিল করা কেন হবে না, তা জানতে চেয়ে আমাদের চিঠি দিয়েছে ইসি। আমরা আইনি ব্যাখ্যাসহ জবাব দিয়েছি। আমরা বলেছি, পিপিআর ও পিপিএ অনুযায়ী যেসব কার্ডের মান খারাপ সেগুলো ঠিক করে দেব। এজন্য দু’মাস সময়ের প্রয়োজন হবে।