খেজুর রস সংগ্রহে গাছে গাছে ব্যস্ত গাছিরা
(ফরিদপুর)সদরপুর থেকেঃ প্রকৃতিতে শীতের হাওয়া বইতে না বইতেই ফরিদপুর অঞ্চলে গাছিরা খেজুরের রস সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মাটির হাড়ি, ছ্যান দা, গাছি দড়ি, নালি ও খিল তৈরীতে তৎপর হয়ে উঠেছে। ফরিদপুর অঞ্চলে সাধারণত খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। সাধারণত খেজুরের বীজ থেকে অঙ্কুরুদগমনের পর থেকে ৬/৭ বছরের পর থেকে খেজুর গাছে রস দেওয়া শুরু করে এবং মৃত্যূ পর্যন্ত রস দিয়ে থাকে। তবে সাধারণত মাঝ বয়সী গাছ থেকে বেশি রস পাওয়া যায়। অন্য গাছের তুলনায় দো-আঁশ ও পলি মাটিতে জন্মানো গাছে বেশি রস পাওয়া যায় বলে জানান গাছিরা। রস সংগ্রহের সাধারণত কার্তিক মাসের শুরু থেকে গাছ কাটা বা রসের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। গাছে সাধারণত ফাল্গুন/চৈত্র মাস পর্যন্ত রস পাওয়া যায়। তবে রসের মান ও পরিমান প্রকৃতিগর উপর নির্ভর করতে হয়। ভাল রস পেতে গাছির দক্ষতার উপরে নির্ভও করতে হয়। এ অঞ্চলে সাধারণত দুইদিন কেটে দুইদিন বিরতী দিতে হয়। আঞ্চলিক ভাষায় প্রথম দিনের রসকে সাধারণত জিরান রস বলে। এই জিরান রস স্বাদে ও ঘ্রানে আলাদা। আর এ রসদিয়ে তৈরী হয় উন্নত মানের পাটালী গুড়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনের রসকে দো-কাট রস বলা হয়। এ রস দিয়েও গুড় তৈরী হয়। কাটার পর বিরতীতে যে রস পাওয়া যায় সেটাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলে ঝরা। এই ঝরার রস দিয়ে সাধারণত ঝোলা গুড় তৈরী করে থাকে। এই ঝোলা গুড় গুনে ও মানে রসের গুড়ের চেয়েও কম। গাছ কাটার মাঝে বিরতী থাকলে, তারপর আবার নতুন করে গাছ কাটা অংশে ছ্যানদা দিয়ে চেছে আবার রস বের করতে হয়। সাধারণত গাছের পূর্ব ও পশ্চিম পাশ বাদ দিয়ে গাছ কাটতে হয়। কারন পূর্ব ও পশ্চিমের অংশে সূর্য্যরে আলো পায়। এতে গাছ দ্রুত শুকিয়ে যায়। ফলে রস কম হয়। তাই গাছিরা এ দিকে লক্ষ রেখে গাছ কাটে। উল্লেখ্য যে ফরিদপুরের খেজুর রস এ অঞ্চলের জস। ফরিদপুরের খেজুরের রস দেশের বিখ্যাত এবং গুড়ের নাম দেশধব্যপী। এখানকার দক্ষ গাছিরা যে পাটালী গুড় তৈরী করে তা দেখতে অনেকটা লালচে হয় এবং স্বাদ মিশ্রির মত। পাটালীর সারা শরীর কাঁচের মত দানায় পরিপূর্ণ। এই পাটালী গুড়ের বাইরের অংশ শক্ত হলেও ভেতরের অংশ থাকে রসে টৈটুম্বুর। এক সময় খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও পাটালী গুড় তৈরী লাভজনক ব্যবসা ছিল। এখন আর আগের মত খেজুর গাছও নাই গাছিও নাই। তাই পাটালী গুড়ের তেমন চাহিদাও নাই। ফলে এই অঞ্চলের শত বছরের ঐতিহ্য ধিরে ধিরে হারাতে বসেছে।কয়েকজন গাছির সাথে কথা বলে জানা গেছে কার্তিক মাসের শুরুর দিকে খেজুর গাছ প্রস্তত করতে হয় রস সংগ্রহের জন্য। গাছের ডগা কেটে বাকল তোলা হয়। গাছের উপরি ভাগের নরম অংশ কেটে বাঁশের তৈরী নল বসানো হয়। গাছের কাটা অংশ থেকে চুইয়ে চুইয়ে রস এসে নল দিয়ে ফোটায় ফোটায় হাড়ির মধ্যে পড়ে। প্রথম সময়ের রস একটু কম মিষ্টি হয়ে থাকে। যত বেশি দিন কাটা হয় তত রস মিষ্টি হয়ে থাকে। দুই এক দিন বিরতীর পর আবার কাটা শুরু করে। এই অঞ্চলের লোক জন খেজুরের রস দিয়ে তৈরী করে নানা ধরণের পিঠা পাঁয়েস। পিঠা তৈরীর পাশাপাশি তৈরী করে নানা ধরনের পাটালী। তাছাড়া এ অঞ্চলের নারিকেল দিয়ে গুড়ের সাথে মিশিয়ে নারিকেল গুড় তৈরী করে। যা স্বাদে ও ঘ্রানে অনন্য। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- বাইরের পাটালীর আবরণ শক্ত আর ভিতরের আবরণ মোমের মত। এ অঞ্চলের মাটি সাধারণত পলিযুক্ত ও দো- আঁশ হওয়ায় লবনাক্ততা কম থাকায় বেশি পরিমানে খেজুর গাছ জন্মে এবং রসও ভাল পাওয়া যায়। ফলে এ অঞ্চলের রস ও গুড় বিখ্যাত হিসেবে সমাদ্রিত। তাছাড়া এ অঞ্চলে মাটির কারনে গাছের শিকড় বেশি নিচে যেতে পারে বিধায় রসও বেশি হয়ে থাকে। গাছিদের খেজুরের রস- গুড় দিয়েই তৈরী হয় গিরহস্থের বাড়ির পিঠা, পুলি, পায়েশসহ বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার। শীতের সকালে খেজুরের রসের পায়েশ, বা রোদে বসে শীতের সকালে খেজুরের রস দিয়ে মুড়ি খাওয়ার মজা উপভোগ করেন বৃদ্ধ-যুবক, শিশুসহ সবাই।